Advertisement
০২ নভেম্বর ২০২৪
High Madrasah Exam

বিড়ি বাঁধার ফাঁকেই নসিফা শুনল, ‘ফার্স্ট’

মুর্শিদাবাদের জঙ্গিপুর মুনিরিয়া হাইমাদ্রাসার শিক্ষকেরাও খানিক হতভম্ব হয়ে গিয়েছেন।

নসিফা খাতুন, তমান্না ইয়াসমিন ও শাহিদ আখতার

নসিফা খাতুন, তমান্না ইয়াসমিন ও শাহিদ আখতার

নিজস্ব প্রতিবেদন 
কলকাতা শেষ আপডেট: ১৭ জুলাই ২০২০ ০৪:০০
Share: Save:

ক্লাসে কখনও প্রথম হয়নি সে। নবম শ্রেণিতে পড়ার সময়ে, এক বার দ্বিতীয় হওয়ায় নিজেই অবাক হয়ে গিয়েছিল। উঠোন জুড়ে ছড়িয়ে থাকা একরাশ বিড়ি বাঁধার ফাঁকে মেয়েটি বলছে, ‘‘জানেন, এ বারও চমকে গিয়েছি। এক্কেবারে ফার্স্ট, কেমন যেন ভয় ভয় করছিল!’’ জঙ্গিপুরের বিড়ি মহল্লার নসিফা খাতুন হাইমাদ্রাসার পরীক্ষায় প্রথম হয়ে শুধু নিজেই নয়, অবাক করে দিয়েছে হতদরিদ্র প্রান্তিক এই মহল্লার মানুষজনকে। দুপুর থেকে তাকে দেখার জন্য তাই ভিড় ভেঙেছে নসিফাদের ছাপোষা উঠোনে। পাড়া-পড়শি সেই অবাক করা গলায় বিড়বিড় করছেন— চেনা মেয়েটার ভিতরে এমন অচেনা ক্ষমতা ছিল কেউ বুঝতেই পারিনি!

মুর্শিদাবাদের জঙ্গিপুর মুনিরিয়া হাইমাদ্রাসার শিক্ষকেরাও খানিক হতভম্ব হয়ে গিয়েছেন। তাঁদেরই এক জনের কথায়, ‘‘পড়াশোনা করত, ক্লাসেও আসত, তা বলে ওই বিড়ি বাঁধা মেয়েটা যে ৯৫ শতাংশ নম্বর পেয়ে প্রথম হয়ে একেবারে তাক লাগিয়ে দেবে সত্যিই ভাবিনি।’’ বৃহস্পতিবার, তার বাড়ির উঠোনে দাঁড়িয়ে তাই মনে হচ্ছিল, অচেনা বিড়ি মহল্লাটা যেন তাকে আঁকড়েই ঘুরে দাঁড়াতে চাইছে।

এ দিনও সকালে মায়ের সঙ্গে বসে বিড়ি বেঁধেছে নসিফা। সে বলছে, ‘‘বৃহস্পতিবার ফল প্রকাশ বলে চাপা উৎকণ্ঠা ছিল। রাতে ঠিকমতো ঘুমোতে পারিনি। বেলা ১২টা নাগাদ দাদা মোবাইলে নেট ঘেঁটে জানাল, ‘ও নসিফা তোর রেজাল্ট জান, ৭৭১ পাইছিস’, তখনও জানি না আমিই প্রথম হয়েছি।’’ একটু পরে বাড়িতে ফোন করে মাদ্রাসার শিক্ষকেরা জানান, হ্যাঁ সেই ‘ফার্স্ট’! অনামী মাদ্রাসা থেকে প্রথম হওয়া অচেনা বিড়ি মহল্লার নসিফার প্রিয় বিষয় ইংরেজি। ইংরেজি নিয়েই পড়তে চায় সে। তবে এখনও জানে না কোথায় ভর্তি হবে সে। তবে সেই অনিশ্চয়তার মাঝে বাবার কথা খুব মনে পড়ছে তার। বাবা তৈয়ব শেখ পেশায় রাজমিস্ত্রি, মা জসেনুর বিবি বাড়িতে বিড়ি বাঁধেন। তবে রুজির টানে তৈয়ব শেখ এখন বর্ধমানে। নসিফা বলে, ‘‘আব্বাকে খবরটা জানাতেই কেঁদে ফেলল জানেন!’’

আরও পড়ুন: নিজেকে সামলান, ধনখড়ের বিরুদ্ধে হুঁশিয়ারির আঙুল তুললেন মমতা

নসিফার মতো আদ্যন্ত অচেনা মহল্লার ঘোর বিস্ময় নেই মালদহের রতুয়ার মেয়েটির। তমান্না ইয়াসমিন এ বার হাই মাদ্রাসা পরীক্ষায় দ্বিতীয় হয়েছে। তার বাবা ইতিহাসে এমএ। মা ভূগোলের স্নাতক। সরকারি চাকরি না জোটায় গ্রামীণ চিকিৎসকের কাজ করেই আয়। তবে সংসারে টানাটানি থাকলেও শিক্ষার ছায়া রয়েছে। তার জোরেই অভাবকে হারিয়ে মেয়ের পড়াশোনার ত্রুটি রাখেননি তাঁরা। মেয়ে যে ভাল ফল করবে সে আশাও ছিল তাঁদের। রতুয়ার ভাদো আদর্শ হাইমাদ্রাসা থেকে পরীক্ষা দিয়ে তমান্না পেয়েছে ৭৬৯। দিনে ঘণ্টা আটেক পড়াশোনার পাশাপাশি ক্রিকেট দেখা আর গল্পের বই পড়াতেও খামতি হয়নি তার। তমান্না বলে, ‘‘এলাকায় চিকিৎসক নেই। বাবার কাছে আসা মানুষগুলোর কষ্ট দেখি। ভবিষ্যতে তাই চিকিৎসক হয়ে এলাকায় কাজ করতে চাই।’’

আরও পড়ুন: খাবার চাই, সেফ হোম থেকে বেরিয়ে পথে বিক্ষোভ

হাই মাদ্রাসায় পরীক্ষায় তৃতীয় হয়েছে মুর্শিদাবাদের লালগোলা রহমতুল্লাহ হাইমাদ্রাসার শাহিদ আখতার। বাবা আবু বক্কর রাজমিস্ত্রির কাজ করেন। নুন আনতে পান্তা ফুরানো সংসারে কখনও বাবাকে সাহায্য করে করে কখনও বা রুজির খোঁজে অন্য কোনও কাজ করে তার পঠনপাঠন। তবে তার পড়ার অদম্য ইচ্ছে দেখে পাশে দাঁড়িয়েছিলেন স্কুলের শিক্ষকেরা। তাঁদের দেওয়া বই আর আর্থিক সাহায্য যে পরীক্ষায় তাকে বিপুল সাহায্য করেছে বিনা দ্বিধায় স্বীকার করছে ছেলেটি। বলছে, ‘‘স্কুলের শিক্ষকেরা না থাকলে, পড়া তো দূরের কথা, রোজ খাবারও জুটত না। এই ফল আমার নয়, ওঁদের!’’

অন্য বিষয়গুলি:

High Madrasah Exam Jangipara Student Education
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE