Advertisement
২২ নভেম্বর ২০২৪
গ্রাম দর্শন
Bangladesh Border

‘কই আর দেখি! সন্ধ্যা ঘনালে সবই আন্ধার’

ভাতের হাঁড়িতে রাজনীতি থাকে। ঘ্রাণও থাকে। কিন্তু রাজনীতির আরশিতে কতটুকুই বা ধরা পড়ে সেই ঘ্রাণ, জীবনের আস্বাদ।

আকবর আলি

আকবর আলি

দেবাশিস চৌধুরী
শেষ আপডেট: ১৪ ফেব্রুয়ারি ২০২১ ০৬:০৯
Share: Save:

হলুদ রং ফিকে হয়ে এসেছে। গায়ে সাঁটা অজস্র পোস্টার। কোনও এক চিটফান্ডের অফিস ছিল নাকি। তারই ছায়া সামনের ঘাসজমিতে। সেখানে বসে এক মনে বেত কেটে চলেছে ছেলেটি।

আসন পিঁড়ি করে বসেছে। কোলের উপরে বিছানো সোয়েটার। দু’পায়ের ফাঁকে বঁটি। সবুজ বেতগাছের ডাল ছুলে বার করছে লিকলিকে কঞ্চি। কোনও দিকে নজর নেই। পাশ থেকে ছুটে গেল অন্য ছেলেরা। প্রশ্ন ছুড়ে দিয়ে গেল— ‘‘কটা পাটি?’’ কাজ থেকে মুখ না তুলে ছেলেটি বলল, ‘‘দেড়টা।’’ ওরা জানতে চায়, ‘‘নাইতে যাবি না?’’ ছেলেটির হাত তখন চলছে সমানে। পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন তার মা। ‘‘পাটি নিবেন নাকি? দেখে যান। এখান থেকে পাটি গোটা রাজ্যে যায়।’’

অলস দুপুরের দিকে এগোচ্ছে ঘুঘুমারি। কোচবিহার-দিনহাটা জাতীয় সড়কের পাশে বর্ধিষ্ণু গ্রাম। বাংলাদেশ সীমান্ত থেকে মিনিট চল্লিশেকের পথ। এই পথে আরও গেলে মিলবে আব্বাসউদ্দিনের জন্মভিটে। গ্রামের পথে তখন ছায়া ছোট হচ্ছে। নুড়ি-পাথরের পথে মাঝে মাঝে দু’একটা সাইকেল, মোটরবাইকের পাশ দিয়ে চলেছে মোবাইল ফোনে কথা বলা তরুণীরা। গ্রামের মধ্যে দিয়ে যে রেল লাইন গিয়েছে, যাকে বারবার টপকাতে একাধিক লেভেল ক্রসিং, তার পাশ ধরে সেই কাজল ভ্রমরারা ভয়ডরহীন ছন্দে একে অন্যের গায়ে ঢলে পড়তে পড়তে হেঁটে চলেছে।

একটু এগিয়ে বৃদ্ধ মানুষটি ছিপ হাতে বসে আছেন ডোবার ধারে। ‘‘কিছু কী পেলেন?’’ ডাক শুনে পিছু ফিরলেন বৃদ্ধ। কানের কাছে হাত নিয়ে শুধোলেন, ‘‘অ্যাঁ?’’ কয়েক বার বলার পরে বুঝতে পারলেন বটে। তার পরে চোখ ফেরালেন ফাতনার দিকে। ছোট্ট শ্বাস ফেলে আব্দুল করিম সাহেব বললেন, অনেকটা স্বগতোক্তির মতো, ‘‘মাছে তো খায় না।’’

এই পথ ঘুরে ঘুরে যায় গৌড়ীয় মঠে। একচালা চার দিক খোলা ঘর। সেখানে কীর্তনের আসর বসে। টাঙানো রয়েছে ফেস্টুন— হরে রাম হরে হরে/ হরে কৃষ্ণ হরে হরে। কীর্তন কি এই গ্রামের অঙ্গ? পথের ধারে খেতের কাজ করতে করতে মুখ তুলে মানুষটি বলেন, ‘‘কীর্তন তো হয়। এখন তো শুনতেই পাবেন।’’

লাইন পার হয়ে গ্রামের অন্য দিকে পাথর ঢালা পথে নামতে নামতে সত্যি ভেসে আসে তেমন সুর। এখন, এই চড়া রোদে কীর্তনের আসর? ‘‘বাড়িতে মনে হয় শ্রাদ্ধ হচ্ছে,’’ বলে গেলেন সাইকেল আরোহী। ধূপের গন্ধ ভেসে আসে। তার পর মোড় ঘুরতেই সব ঢেকে দিয়ে মাইকের শব্দ: ‘চোখে দেখতে পান না? আবছা দেখেন? চলে আসুন চোখের আলো শিবিরে। আগামিকাল সকালে...।’ মাইক আর লোক নিয়ে টোটো এগিয়ে যায়। সে দিকে তাকিয়ে পথের ধারে বসে থাকেন আকবর আলি। হাড় জিরজিরে শরীর বেঁকে নুয়ে পড়েছে সামনে। ডাক দিলে মুখ তুলে তাকান। দাঁতের পাটি গলে ফোকলা হাসি লেগে আছে মুখে।

‘‘দেখতে পান চোখে?’’

‘‘কই আর দেখি! সন্ধ্যা ঘনালে সব আন্ধার।’’

‘‘যাবেন না চোখের আলো শিবিরে?’’

‘‘কী হবে যেয়ে? তিন বছর আগে গেছিলাম। বসেই রইলাম। কেউ দেখল না।’’

কেউ দেখে না? মাথা নাড়েন বৃদ্ধ। হাতের উপরে আঙুল চালিয়ে ইঙ্গিত করে বলেন, ‘‘দেখলেও দু’মিনিট। তার পরে হিজিবিজি লিখে বলে, যাও।’’

পথের ওপারে তাঁর টিনের চালা। পিছনে এসে দাঁড়িয়েছেন বৃদ্ধের পুত্রবধূ। চোখেমুখে অপার কৌতূহল। কিন্তু জিজ্ঞেস করছেন না কিছুই। ‘‘এই বাজারটা রাখো গো,’’ বলে বধূর হাতে থলে ধরিয়ে দিলেন এক যুবক। অন্য মুঠো থেকে হঠাৎ থলে খুলে পথে গড়াগড়ি দিল ‘খইলসা’ মাছ। হুড়োহুড়ি করে সে সব কুড়িয়ে নিয়ে যাওয়ার পরেও বন্ধুর মায়ার মতো রয়ে গেল একটি। কুড়িয়ে নিলেন বধূটি।

দুলে দুলে চলেছেন এক আধখেপা মানুষ। গুন গুন করে সুর ধরছেন, ‘কৃষ্ণ প্রেম যার অন্তরে লেগেছে...’। রাস্তার পাশেই বড় চালা ঘর। উঁকি দিতে দেখা গেল, সার সার সরস্বতী ঠাকুর। শেষ বারের মাটি চাপছে। এগিয়ে এলেন নন্দ বর্মণ। তিনিই মূল কারিগর। ঠাকুর বায়না হল? ‘‘কই আর হল? এ বারে তো বেশির ভাগ স্কুলেই পুজো হবে না।’’ তার পর প্রায় অন্ধকার ঘরের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘‘কত বড় বড় ঠাকুর গড়তাম। এ বারে আর হল না।’’

ছেলেটি এখনও বেত কেটে চলেছে। সপ্তম শ্রেণি। হাতে তার দেড়খানা পাটি। ‘‘কটা পাটি বানাও রোজ?’’ মুখ না তুলে সে বলে, ‘‘দুটো অবধি হয়ে যায়।’’ আর স্কুল, অনলাইন ক্লাস? মাথা নাড়ে সে, ‘‘হয় না তো এখন। সব বন্ধ।’’ মা মমতা সরকার আবার বার হয়ে আসেন। বলেন, ‘‘পাটি নিবেন? ভিতরে আসেন না।’’ কোন পাটি ভাল? মমতা বলেন, ‘‘ডালার পাটি বা বুকার পাটি দেখে যান। ভাল চলবে।’’

ছেলেটির দিকে ফিরে জানতে চাই, কী নাম তোমার? মুখ না তুলে সে বলে, ‘‘জয়তীর্থ সরকার।’’ চিটফান্ডের বাড়ির ছায়া কমে গিয়েছে। তার অপাপবিদ্ধ মুখের এক ধারে এসে পড়ে দুপুরের রোদ। তাতে কোনও ভোট পতাকার ছায়া নেই।

অন্য বিষয়গুলি:

Bangladesh Border Bamboo plant Gram Darshan
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy