বঙ্গ বিজেপির চার শীর্ষ নেতাকে দিল্লিতে তলব করে কড়া বার্তা দিলেন অমিত শাহ। গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।
অনৈক্য নিয়ে নেতৃত্বের উদ্বেগ ছিলই। খোদ সরসঙ্ঘচালক সে উদ্বেগের কথা বিজেপির রাজ্য নেতৃত্বকে জানিয়ে গিয়েছিলেন। এ বার হুঁশিয়ারি দিয়ে দেওয়া হল বলে খবর। পশ্চিমবঙ্গ বিজেপিতে কোনও অনৈক্য বরদাস্ত করা হবে না, যাবতীয় ঘরোয়া কোন্দল দূরে সরিয়ে রেখে সর্বশক্তিতে ঝাঁপাতে হবে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিরুদ্ধে— বঙ্গ বিজেপির চার শীর্ষ নেতাকে দিল্লিতে তলব করে এই বার্তাই দিয়ে দিলেন অমিত শাহ। খবর বিজেপি সূত্রের।
রাজ্য বিজেপির সভাপতি দিলীপ ঘোষ, সাধারণ সম্পাদক (সংগঠন) সুব্রত চট্টোপাধ্যায়, জাতীয় কর্মসমিতির সদস্য মুকুল রায় এবং প্রাক্তন রাজ্য সভাপতি তথা বর্তমানে কেন্দ্রীয় সম্পাদক পদে থাকা রাহুল সিংহ— বঙ্গ বিজেপির এই চার নেতাকে দিল্লিতে ডেকে পাঠিয়েছিলেন দলের সর্বভারতীয় সভাপতি অমিত শাহ। জে পি নাড্ডা দলের কার্যকরী সভাপতি হওয়ার পর থেকে বঙ্গ বিজেপির শীর্ষ নেতৃত্বের সঙ্গে এ ভাবে আলাদা করে বৈঠকে অমিত শাহ আর এক বারও বসেননি। তাই এই বৈঠকের দিকে উৎসুক নজর ছিল গোটা বাংলার রাজনৈতিক শিবিরের।
সম্প্রতি রাজ্য বিজেপির কয়েক জন নেতা দলের কিছু অভ্যন্তরীণ টানাপড়েন নিয়ে প্রকাশ্যে মুখ খুলতে শুরু করেছিলেন। যাঁদের বিরুদ্ধে মুখ খুলছিলেন, পাল্টা প্রতিক্রিয়া তাঁদের দিক থেকেও আসছিল। ঠিক সেই পরিস্থিতিতেই খবর মেলে যে, রাজ্য বিজেপির চার শীর্ষ নেতাকে দিল্লিতে ডেকে পাঠিয়েছেন অমিত শাহ। ফলে রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের কাছে এই বৈঠকের গুরুত্ব আরও বেড়ে যায়।
আরও পড়ুন: ‘ধুঁকছে অর্থনীতি, বিপন্ন গণতন্ত্র’, বৈঠকে দলকে বার্তা সনিয়ার, ঝাঁপিয়ে পড়ার নির্দেশ
বিজেপি সূত্রের খবর, তৃণমূলকে আক্রমণ করার কথা ভুলে বিজেপির রাজ্য নেতারা যে ভাবে অভ্যন্তরীণ গোলমালে জড়িয়েছেন, তাতে অমিত শাহ অত্যন্ত অসন্তুষ্ট। বুধবারের বৈঠকে সে অসন্তোষ তিনি আর গোপন রাখেননি। পুরনো-নতুন দ্বন্দ্ব ভুলে সবাইকে নিয়ে চলার পরামর্শ বিজেপির রাজ্য নেতৃত্বকে আগেই দিয়েছিল দিল্লি। তৃণমূল বা অন্যান্য দল ছেড়ে যাঁরা বিজেপিতে যোগ দিচ্ছেন, তাঁদের উপযুক্ত স্থান দিতে হবে এবং কাজে লাগাতে হবে— এই বার্তাও দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু রাজ্য বিজেপি সেই পথে হাঁটতে পারেনি বলে সর্বভারতীয় নেতৃত্বের মনে হয়েছে। এই পরিস্থিতি আর বরদাস্ত করা হবে না, প্রয়োজন হলে সাংগঠনিক রদবদলের রাস্তায় হাঁটতেও প্রস্তুত দল— এই বার্তা বাংলার চার নেতাকে দিয়ে দেওয়া হয়েছে বলে খবর।
আরও পড়ুন: হাজরায় মমতার উপর হামলা, ২৯ বছর পর বেকসুর খালাস লালু আলম
‘অনৈক্য’ নিয়ে অমিত শাহের অসন্তোষের বিষয়ে বৈঠকে উপস্থিত বিজেপি নেতারা কেউই মুখ খোলেননি এখনও। কিন্তু দিল্লি থেকে ফোনে আনন্দবাজারকে মুকুল রায় বলেন, ‘‘অমিতজি আমাদের বলেছেন, পশ্চিমবঙ্গে বিজেপিকে ঐক্যবদ্ধ ভাবে পথে নামতে হবে, সর্বশক্তি দিয়ে মমতার বিরুদ্ধে পথে নামতে হবে।’’ মুকুলের এই মন্তব্যেই স্পষ্ট যে, বাংলায় বিজেপির ‘ঐক্যবদ্ধ’ চেহারা দেখতে চাইছেন দলের সর্বভারতীয় নেতৃত্ব।
আরও পড়ুন: থানার মধ্যেই মহিলার হাতে হরিদেবপুরে মার খেল পুলিশ, গ্রেফতার অভিযুক্ত
লোকসভা নির্বাচনের ফল প্রকাশিত হওয়ার পরে পশ্চিমবঙ্গে বিভিন্ন দল ছেড়ে বিজেপিতে যোগ দেওয়ার প্রবণতা বেড়েছিল। কিন্তু রাজ্য বিজেপির একটি অংশ তৃণমূল থেকে অবাধে দলে লোক ঢুকতে দেওয়ার বিরোধী। রাজ্য সভাপতি দিলীপ ঘোষ কখনও বলেননি যে, তৃণমূল থেকে কাউকে বিজেপিতে নেওয়া হবে না। তিনি বরং বার বারই বলেছেন যে, দলের দরজা সবার জন্য খোলা। কিন্তু গেরুয়া পতাকা হাতে তুলে নেওয়ার পরে শোভন চট্টোপাধ্যায় ও বৈশাখী বন্দ্যোপাধ্যায়কে যে আক্রমণ বিজেপিরই একটি অংশ করেছে, সে আক্রমণ বন্ধ করতে রাজ্য সভাপতি দিলীপ ঘোষ উপযুক্ত ভূমিকা নিতে পারেননি বলে কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের মনে হয়েছে। এই পরিস্থিতি যে চলতে পারে না, সে বার্তাও রাজ্য নেতাদের দিয়ে দেওয়া হয়েছে বলে খবর।
লোকসভা নির্বাচনের প্রচারে গোটা বাংলা চষে ফেলার সময়ে নরেন্দ্র মোদী এবং অমিত শাহ বার বার ইঙ্গিত দিয়েছিলেন যে, তৃণমূলে বড়সড় ভাঙন ধরাতে প্রস্তুত বিজেপি। তৃণমূলের ক’জন বিধায়ক তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ রেখে চলছেন, নির্বাচনী জনসভা থেকে সে কথাও বলে গিয়েছিলেন মোদী। অর্জুন সিংহ, সৌমিত্র খাঁ, খগেন মুর্মু বা নিশীথ প্রামাণিক— রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্তে একের পর এক পরিচিত নাম তৃণমূল বা অন্যান্য দল ছেড়ে বিজেপিতে যোগ দেওয়া শুরু করেছিলেন ভোটের আগেই। ভোটের পরে সেই ভাঙন আরও তীব্র হতে শুরু করেছিল। কিন্তু অচিরেই তা থেমে যায়। রাজ্য বিজেপির একটি শিবিরের দাবি, বিজেপিতে যোগ দিয়ে আদৌ কতটা গুরুত্ব মিলবে, তা নিয়ে সংশয় তৈরি হয়েছে বলেই অনেক বড় বড় নাম জোড়াফুল ছেড়ে পদ্মফুলে নাম লেখানোর আগে দশ বার ভাবছেন।
পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বিগ্ন সঙ্ঘও। চলতি মাসের শুরুতেই কলকাতার সঙ্ঘ সদর দফতর কেশব ভবনে দিলীপ ঘোষ এবং সুব্রত চট্টোপাধ্যায়কে নিয়ে বৈঠকে বসেছিলেন আরএসএস প্রধান মোহন ভাগবত। দল যখন বাড়ছে, তখন নেতৃত্বের ভূমিকা কেমন হওয়া উচিত, সে বিষয়ে ভগবত কিছু পরামর্শ দিয়েছিলেন বলেও সঙ্ঘ সূত্রে জানা গিয়েছিল। কিন্তু পরিস্থিতি বদলায়নি। কখনও শোনা গিয়েছে যে, মুকুল রায়ের গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে একটি অংশ। কখনও শোভন-বৈশাখীকে নিয়ে প্রকাশ্যে কু-মন্তব্য করা হয়েছে। তাই এ বার হস্তক্ষেপ করেছেন খোদ অমিত শাহ। দলের মধ্যে কোনও অনৈক্য বরদাস্ত করা হবে না, সকলকে সঙ্গে নিয়ে এবং উপযুক্ত মর্যাদা দিয়ে কাজ করতে হবে, না হলে কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব পদক্ষেপ করবে— এই রকম হুঁশিয়ারিই দিয়ে দেওয়া হয়েছে।
বুধবার রাত ৮টার পরে বাংলার নেতাদের নিয়ে অমিত শাহ বৈঠকে বসেছিলেন। বাংলার দায়িত্বপ্রাপ্ত দুই কেন্দ্রীয় পর্যবেক্ষক কৈলাস বিজয়বর্গীয় এবং অরবিন্দ মেননকেও সে বৈঠকে ডাকা হয়েছিল। বৈঠকে অমিত শাহ বার্তা দেন, তৃণমূলকে ক্রমশ দুর্বল করা এখন বাংলায় বিজেপির একমাত্র লক্ষ্য হওয়া উচিত। তৃণমূল মহাসচিব তথা রাজ্যের শিক্ষামন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে এ রাজ্যের এক শীর্ষ বিজেপি নেতার ঘনিষ্ঠতা নিয়ে অমিত শাহ প্রশ্ন তোলেন বলেও খবর বিজেপি সূত্রের।
শোভন চট্টোপাধ্যায় এবং বৈশাখী বন্দ্যোপাধ্যায়কে নিয়েও বুধবার রাতের বৈঠকে কথা হয়েছে বলে জানা গিয়েছে। দলে যোগ দেওয়ার সপ্তাহ দুয়েক কাটতে না কাটতেই বিজেপি ছাড়ার ইচ্ছা প্রকাশ করেছিলেন শোভনরা। পরে পরিস্থিতি কিছুটা স্তিমিত হয়েছে বটে। কিন্তু জটিলতা পুরোপুরি কেটে গিয়েছে, এমন নয়। অমিত শাহের সামনে বুধবার রাতে সে প্রসঙ্গ মুকুল রায়ই তোলেন বলে খবর। সে প্রসঙ্গেও সকলকে সঙ্গে নিয়ে এবং উপযুক্ত মর্যাদা দিয়ে কাজ করার কথাই দলের সর্বভারতীয় সভাপতি দিয়েছেন বলে খবর।
অমিত শাহ ঠিক কী বলেছেন, সে বিষয়ে মুকুল রায় মুখ খোলেননি। তবে তাঁর কথায়, ‘‘শোভন-বৈশাখী দলে ছিলেন এবং থাকছেন। সুতরাং সবাইকে সেই অনুযায়ীই চলতে বলা হয়েছে।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy