বীরভূমের বিজেপি নেতা দুধকুমার মণ্ডল গ্রাফিক: সনৎ সিংহ।
বীরভূমের বিজেপি নেতা দুধকুমার মণ্ডল প্রকাশ্যে দলের বিরুদ্ধে ক্ষোভ উগরে দেওয়ার পর অস্বস্তিতে বিজেপি শিবির। এর আগেও বিভিন্ন জেলার অনেক নেতা নেটমাধ্যমে সরব হয়েছেন। কেউ কেউ রাজ্য নেতৃত্বকে সরাসরি চিঠি পাঠিয়েছেন। তবে এ বার অস্বস্তি অনেকটাই বেশি। কারণ, দলের দুর্দিনে বিজেপির পতাকা যাঁরা তুলে ধরেছিলেন, দুধকুমার তাঁদের অন্যতম।
সেই ‘আদি’ নেতার কেন এত ক্ষোভ? আরও অনেকের ক্ষোভ কেন মাঝেমাঝেই প্রকাশ্যে এসে যাচ্ছে? এর আড়ালে সংগঠনে গভীর ক্ষত দেখছে রাজ্য বিজেপির একাংশ।
দুধকুমার রবিবার ফেসবুকে লিখেছেন, ‘ভারতীয় জনতা পার্টির সমর্থক এবং কার্যকর্তাগণ আমাকে যাঁরা ভালবাসেন তাঁরা চুপচাপ বসে যান।’ যা নিয়ে এক রাজ্য নেতার বক্তব্য, ‘‘উনি চুপচাপ বসে যেতে বলেছেন। কিন্তু তার অনেক আগেই নীচু স্তরের বহু কর্মী তো বটেই, অনেক নেতাও চুপচাপ বসে গিয়েছেন। কেউ কেউ রাজ্যের নেতারা জেলায় গেলে মিছিলে হাঁটেন, বৈঠকে যোগ দেন। কিন্তু দলের দৈনন্দিন কাজের সঙ্গে তাঁদের কোনও যোগ নেই।’’ দলের রাজ্য কমিটির সদস্য আর এক নেতার বক্তব্য, ‘‘দুধকুমার মণ্ডল অনেক বার জনপ্রতিনিধি হয়েছেন বলে পরিচিত নাম। কিন্তু ফেসবুকে প্রায়ই কেউ না কেউ দলের বিরুদ্ধে সরব হচ্ছেন। জেলায় জেলায় অনেকেই দলের কাজকর্মের বিরুদ্ধে মুখ খুলছেন। তবে সরব হচ্ছেন, এমন নেতা-কর্মীর সংখ্যাও খুব কম। বড় অংশই চুপচাপ বসে গিয়েছে।’’ রাজ্যের শীর্ষনেতৃত্ব সব জেনেও চুপ করে রেয়েছেন বলেও অভিযোগ ওই নেতার।
দুধকুমারের ‘বিদ্রোহের’ সপ্তাহ খানেক আগেই ১৫ জুন পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার গড়বেতায় দলের কাজকর্ম নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করে বিজেপি ছাড়েন ১৫ জন নেতা-কর্মী। গড়বেতা ১ নম্বর মণ্ডল অফিসে তালা ঝুলিয়ে দেন বিক্ষুব্ধরা। মে মাসেই আলিপুরদুয়ারে জেলা সভাপতি কমলেশ রায় ও জেলা সম্পাদক রতন তরফদারকে দলীয় দফতরে আটকে রেখে রাতভর বিক্ষোভ দেখান দলেরই কর্মীরা। এই সব উদাহরণের কথা উল্লেখ করে রাজ্য বিজেপির ওই নেতা বলেন, ‘‘প্রতি সপ্তাহেই এমন কিছু না কিছু হচ্ছে। সবটা জানাজানি হয় না। রাজ্য দফতরে নালিশের পাহাড় জমেছে। বেশির ভাগ জায়গায় অভিযোগ নতুন কমিটি নিয়ে। কোথাও জেলা, কোথাও মণ্ডল কমিটি নিয়ে অপছন্দের কথা সামনে আসছে। কিন্তু আসল কারণ হল, দলের কর্মীরা কাজ করার উৎসাহ পাচ্ছেন না। আর কর্মীরা সঙ্গে না থাকায় স্থানীয় নেতারাও হতাশ। সেটাই কখনও কখনও প্রকাশ্যে এসে যাচ্ছে। কিন্তু যাঁরা প্রকাশ করছেন, তাঁদের চেয়েও যাঁরা প্রকাশ করছেন না, তাঁদের সংখ্যা অনেক বেশি।’’
বিধানসভা নির্বাচনে আশানুরূপ ফল না হওয়ার পর থেকেই বিজেপিতে ভাঙনের ছবি। নেতা থেকে কর্মীদের অনেকেই দলবদল করেছেন। বার বার ক্ষোভ সামনে এসেছে। কিন্তু দুধকুমারের মতো পুরনো দিনের নেতা সরব হওয়া ভাবাচ্ছে গেরুয়া শিবিরকে। রবিবারই রাজ্য সভাপতি সুকান্ত মজুমদার জানিয়ে দিয়েছিলেন, দলের উপরে নন কেউই। বীরভূমের প্রাক্তন জেলা সভাপতি তথা বর্তমানে রাজ্য কর্মসমিতির সদস্য দুধকুমারের অভিযোগ, তাঁর সঙ্গে আলোচনা না করেই জেলা থেকে ব্লক কমিটি গঠন হয়েছে। এ নিয়ে সুকান্ত বলেন, ‘‘পার্টির সংবিধানে কোথাও লেখা নেই, দুধকুমার মণ্ডলের সঙ্গে আলোচনা করে এই কমিটিগুলো করতে হবে।’’ দুধকুমারের বিরুদ্ধে দলীয় শৃঙ্খলাভঙ্গের অভিযোগ আনা হতে পারে বলেও জানান বিজেপি নেতৃত্ব। তবে মঙ্গলবার পর্যন্ত সেই মর্মে কোনও পদক্ষেপ করা হয়নি।
প্রসঙ্গত, দলেরই একটি অংশ অবশ্য মনে করছে, প্রবীণ নেতা দুধকুমারকে শাস্তির চিঠি না দিয়ে আলোচনার মাধ্যমে সমাধানের পথে হাঁটা উচিত। সেই অংশের এক নেতার কথায়, ‘‘বীরভূমের ওই অঞ্চলে বিজেপি এবং দুধকুমার মণ্ডল সমার্থক। তা ছাড়া যখন থেকে উনি পঞ্চায়েত ভোটে জিতছেন, তখন রাজ্যে দলের তেমন কোনও সংগঠনই ছিল না। তাঁর বিরুদ্ধে কোনও শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিলে এমনিতেই দলের সঙ্গে দূরত্ব রেখে চলা পুরনো দিনের নেতাদের ক্ষোভ বাড়তে পারে।’’
সেই আশঙ্কা যে একেবারে উড়িয়ে দেওয়া যায় না, তা বোঝা গিয়েছে দুধকুমার সরব হওয়ার পরেই। রাজ্য বিজেপির প্রাক্তন সভাপতি তথাগত রায় টুইটারে লেখেন, ‘বলতে দ্বিধা নেই, আমি দুধকুমার মণ্ডলকে ভালবাসি। বীরভূম জেলার বহুকালের সংগ্রামী নেতা, একসঙ্গে প্রচুর কাজ করেছি।’ বীরভূমের বোলপুর আসনের প্রাক্তন সাংসদ তথা বিজেপির সর্বভারতীয় সম্পাদক অনুপম হাজরা ফেসবুকে লেখেন, ‘দুধকুমারদা’র মতো মানুষ সংগঠন থেকে হারিয়ে গেলে, তা চিন্তার এবং উদ্বেগের! বর্তমানে যাঁরা সংগঠনে আছেন, তাঁদের উচিত দুধকুমার মণ্ডলের মতো পুরনো মানুষ যারা সাংগঠনিক ভাবে বলিষ্ঠ, তাঁদের অভিজ্ঞতা এবং পরামর্শকে যথাযথ সম্মান এবং গুরুত্ব দিয়ে সংগঠনের সামনের সারিতে আনা।’
২০১১ সালে নিজের এলাকা ময়ূরেশ্বর থেকে বিধানসভা নির্বাচনে লড়েছিলেন দুধকুমার। কিন্তু ২০১৬ সালের নির্বাচনে দলের নির্দেশে সেই আসন লকেট চট্টোপাধ্যায়কে ছেড়ে চলে যান রামপুরহাটে। তবে এখন হুগলির সাংসদ তথা রাজ্য বিজেপির সাধারণ সম্পাদক লকেটের হয়ে প্রচারে বড় ভূমিকা নেন তিনি। সেই দুধকুমার কেন এমন বিক্ষুব্ধ? আনন্দবাজার অনলাইনকে লকেট বলেন, ‘‘দুধকুমার’দার কী হয়েছে বুঝতে পারছি না। আমার সঙ্গে অনেক দিনই যোগাযোগ নেই।’’ তবে দলের ভেঙে-পড়া সংগঠন নিয়ে প্রশ্নের উত্তর এড়িয়ে গিয়েছেন লকেট। তাঁর কথায়, ‘‘এটা একেবারেই দলের অভ্যন্তরীণ বিষয়। বাইরে বলার কথা নয়।’’
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, Twitter এবং Instagram পেজ।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy