প্রসন্ন রায়। ফাইল ছবি
জেলায় জেলায় জাল ছড়িয়ে টাকার বিনিময়ে স্কুলে স্কুলে দেদার নিয়োগ। তদন্তকারীদের কথায় যা ‘চেন সিস্টেম’। এবং এক জন প্রসন্ন রায় বা জনৈক প্রদীপ সিংহ নন। স্কুলে নিয়োগ দুর্নীতির সেই বঙ্গময় চেন বা জালে দু’শো-আড়াইশো প্রসন্ন ও প্রদীপ কাজ করতেন বলে সিবিআইয়ের দাবি।
তদন্তকারীরা জানাচ্ছেন, প্রসন্ন ও প্রদীপ মূলত উত্তর ও দক্ষিণ ২৪ পরগনার অযোগ্য ও মেধা-তালিকার নীচের দিকে থাকা চাকরিপ্রার্থীদের নামের তালিকা তৈরি করে এসএসসি বা স্কুল সার্ভিস কমিশনের তৎকালীন উপদেষ্টা শান্তিপ্রসাদ সিংহের কাছে পাঠাতেন। রাজ্যের অন্যত্র সেই কাজে যুক্ত ছিলেন আরও অনেক প্রসন্ন ও প্রদীপ। বিভিন্ন জেলায় রাজ্যের প্রাক্তন শিক্ষামন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের ঘনিষ্ঠেরা ছিল ওই জাল চক্রের পান্ডা।
এক সিবিআই-কর্তা জানান, পার্থ তাঁর ঘনিষ্ঠদের নিয়ে গত দশ বছরে একটা ‘চেন সিস্টেম’ গড়ে সরকারি চাকরি বিক্রি করে কোটি কোটি টাকা তুলেছিলেন। সেই টাকায় পার্থ-ঘনিষ্ঠেরা নামে-বেনামে বিপুল সম্পত্তি কিনেছেন। প্রদীপ-প্রসন্নকে জেরার ভিত্তিতে তদন্তকারীদের দাবি, রাজ্যে পার্থ-ঘনিষ্ঠ ২০০-২৫০ ‘প্রসন্ন’ ও ‘প্রদীপ’ যুক্ত ছিলেন দুর্নীতির জালে। যার মূল নিয়ন্ত্রক স্বয়ং পার্থ। যিনি ইডি-এর মামলায় এখন জেল হেফাজতে।
তদন্তে সিবিআই জেনেছে, ওই পার্থ-ঘনিষ্ঠেরা এসএসসি, প্রাথমিক টেট-সহ শিক্ষা ক্ষেত্রের বিভিন্ন নিয়োগে অযোগ্য, মেধা-তালিকার নীচের দিকের প্রার্থীদের কাছ থেকে মোটা টাকা নিয়ে নামের তালিকা তৈরি করে পার্থের নির্দেশে শান্তি ছাড়াও শিক্ষা দফতরের কিছু কর্তার কাছে পৌঁছে দিতেন। শান্তি এবং শিক্ষা দফতরের পার্থ-ঘনিষ্ঠ অফিসারদের ‘সিন্ডিকেট’ সেই তালিকা অনুযায়ী তথ্য বিকৃত করে বেআইনি ভাবে সেই সব প্রার্থীকে নিয়োগ করত। প্রসন্ন ও প্রদীপকে জেরা করে দুর্নীতি কাণ্ডে শিক্ষা দফতরের কিছু কর্তা ও শাসক দলের কর্মচারী সংগঠনের কিছু নেতার নাম মিলেছে। চাকরি বিক্রির লক্ষ লক্ষ টাকা পার্থের নির্দেশেই নির্দিষ্ট জায়গায় পৌঁছে দিতেন প্রসন্নের মতো ‘মিডলম্যান’ বা দালালেরা।
এক সিবিআই-কর্তা বলেন, ‘‘এসএসসি-সহ শিক্ষা ক্ষেত্রে সমস্ত চাকরির দুর্নীতি কাণ্ডে অভিযুক্তদের আয়ের সঙ্গে সামঞ্জস্যহীন সম্পত্তির তদন্ত করছে ইডি। দুর্নীতি কী ভাবে সংগঠিত হয়েছিল, সেই দুর্নীতিতে কারা জড়িত ছিল, তার তদন্ত করছে সিবিআই।’’ ওই কর্তার সংযোজন, কলকাতা হাই কোর্টের নির্দেশে গঠিত প্রাক্তন বিচারপতি রঞ্জিতকুমার বাগের নেতৃত্বাধীন কমিটির তদন্ত রিপোর্ট বলছে, শিক্ষা দফতরের প্রধান সচিব মণীশ জৈন কমিটিকে জানিয়েছেন, নিয়োগের ক্ষেত্রে মূল নিয়ন্ত্রক ছিলেন পার্থই। প্রধান সচিবের বক্তব্যই এখন স্পষ্ট হচ্ছে বলে জানান তদন্তকারীরা।
সিবিআইয়ের এক কর্তা বলেন, ‘‘হাই কোর্টের বিচারপতি অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায় এজলাসেই এসএসসি-দুর্নীতির ‘নাটের গুরু’ হিসেবে শান্তির নাম উল্লেখ করেছিলেন। বিচারপতির পর্যবেক্ষণ ছিল, ওই ঘটনায় পার্থ চট্টোপাধ্যায়কেও জিজ্ঞাসাবাদের প্রয়োজন রয়েছে। কেন তিনি সে-কথা বলেছিলেন, তা সহজেই অনুমেয়।’’
শান্তিপ্রসাদ ছাড়াও এসএসসি-র প্রাক্তন উপদেষ্টা অশোক সাহাকে জেরা করে নিউ টাউনের বাসিন্দা প্রদীপ ও প্রসন্নকে গ্রেফতার করা হয়। তদন্তকারীরা জেনেছেন, প্রসন্ন পার্থের ঘনিষ্ঠ আত্মীয় এবং তিনিই চাকরি বিক্রির অন্যতম দালাল। আর প্রদীপ তাঁর শাগরেদ। শান্তিপ্রসাদ ও প্রদীপের বয়ানের ভিত্তিতে এবং প্রসন্নের অফিস থেকে বাজেয়াপ্ত নিয়োগ সংক্রান্ত নথি থেকে পার্থ-ঘনিষ্ঠ আরও কয়েক জনের নাম পেয়েছে সিবিআই। প্রসন্ন ভ্রমণ সংস্থা ও গাড়ি ব্যবসার আড়ালে সল্টলেকে বসে এসএসসি, প্রাথমিক টেট-সহ চাকরি দুর্নীতির কার্যালয় চালাতেন বলে অভিযোগ। সল্টলেকের জিডি ব্লকের ২৫৩ নম্বর বাড়িতে তাঁর অফিসে সিসি ক্যামেরা ছিল না।
তদন্তকারীদের অনুমান, কার্যকলাপ অন্ধকারে রাখতে ইচ্ছে করেই সিসি ক্যামেরা লাগানো হয়নি। তদন্তকারীদের দাবি, রাজারহাট-নিউ টাউনে নামে-বেনামে জমি-বাড়ি, বিভিন্ন আবাসনে ফ্ল্যাট, একাধিক চা-বাগানের মালিকানা ছাড়াও সুন্দরবনের কিছু রিসর্টের মালিকানায় যোগসূত্র আছে প্রসন্নের। তদন্তকারীরা জানান, রং-মিস্ত্রি প্রসন্ন গত দশ বছরে বিপুল সম্পত্তির মালিক হয়েছেন। চাকরি বিক্রির টাকা ওই সব সম্পত্তিতে বিনিয়োগ করা হয়েছে বলে প্রাথমিক তদন্তের ভিত্তিতে অনুমান করা হচ্ছে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy