Advertisement
২৬ নভেম্বর ২০২৪

পুজোতেই মুক্তি পেত অপরাজিত থেকে অমানুষ

মাল্টিপ্লেক্স তখনও জন্মায়নি। মহালয়ার সপ্তাহে এল তারকাখচিত ‘চৌরঙ্গী’। আর এক বার পুজোর সপ্তাহে ‘শঙ্খবেলা’। ফি বছর সিনেমার শারদ-উৎসব।অথচ পৌরাণিক ছবিতে বীরেন্দ্রকৃষ্ণের যোগদান এই প্রথম নয়। ১৯৪৫ সালের পুজোয় মুক্তিপ্রাপ্ত ‘শ্রীদুর্গা’ ছবিতেও চণ্ডীপাঠের দায়িত্ব তাঁরই ছিল। সে কালে পুজোর সময় পৌরাণিক ছবি আসত মাঝেমধ্যেই!

জাগরী বন্দ্যোপাধ্যায়
শেষ আপডেট: ২৮ সেপ্টেম্বর ২০১৭ ০১:১৩
Share: Save:

গোটা চিত্রনাট্য এবং চার কপি শ্রীশ্রীচণ্ডী পাঠিয়ে দিয়েও লাভ হল না। সেন্সর-অসুরে থমকে গেলেন মহামায়া!

১৯৫২ সাল। সে বার পুজোয় একটিই নতুন বাংলা ছবি আসার কথা, ‘মহিষাসুর বধ’। ছবির চিত্রনাট্য করেছেন বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র। তবু চণ্ডীবন্দনায় কোনও ত্রুটি থেকে গিয়েছে কি না, খুঁটিয়ে বিচার করতে সেন্সর বোর্ডের কর্তারা ছবি দেখার পরে চিত্রনাট্যের কপি এবং শাস্ত্রের বই চেয়ে পাঠিয়েছেন। শেষ অবধি খবরের কাগজে বড় করে বিবৃতি দিলেন প্রযোজকরা। তাঁদের খেদ, সব কিছু হাতের সামনে এগিয়ে দেওয়া সত্ত্বেও এবং বঙ্গজীবনে শারদোৎসবের গুরুত্বটা জানা সত্ত্বেও সেন্সর বোর্ড সময়ে কাজ শেষ করল না। পুজোয় অন্তত ছবিটা বাঙালিকে দেখানো গেল না।

অথচ পৌরাণিক ছবিতে বীরেন্দ্রকৃষ্ণের যোগদান এই প্রথম নয়। ১৯৪৫ সালের পুজোয় মুক্তিপ্রাপ্ত ‘শ্রীদুর্গা’ ছবিতেও চণ্ডীপাঠের দায়িত্ব তাঁরই ছিল। সে কালে পুজোর সময় পৌরাণিক ছবি আসত মাঝেমধ্যেই! দশ অবতার, শিবশক্তি, মাথুর, মহাতীর্থ কালীঘাট, মহিষাসুরমর্দিনী, সবই পুজো রিলিজ। ১৯৩৪ সালের পুজোয় ‘দক্ষযজ্ঞ’ ছবির বিজ্ঞাপন বেরিয়েছিল একেবারে কাগজের প্রথম পাতায়। পুজোকে ছবির প্রচারের কাজে লাগানোর রেওয়াজটা এর পর থেকেই অন্য মাত্রায় নিয়ে গেল নিউ থিয়েটার্স। ১৯৩৬ সালে ‘গৃহদাহ’র ঢাউস বিজ্ঞাপনে লেখা হল, ‘অদ্য হইতে শারদীয়ার আনন্দ উৎসব আরম্ভ হইল।’ পরের বছর পুজোর দু’সপ্তাহ আগেই ‘শারদীয় আনন্দ নিবেদন’ বলে এসে গেল প্রমথেশ বড়ুয়ার ‘মুক্তি’।

বস্তুত বাংলার আদি ও স্বর্ণযুগের অনেক নামজাদা ছবিই আত্মপ্রকাশ করেছে পুজোয়। চণ্ডীদাস, জীবন মরণ, অঞ্জনগড়, বাবলা, ব্রতচারিণী, ইন্দ্রাণী, অন্নদাদি ও শ্রীকান্ত, অ্যান্টনি ফিরিঙ্গি, মন নিয়ে, মেমসাহেব, অমানুষ, আনন্দ আশ্রম...তালিকা লম্বা। আবার এও ঠিক, যেনতেনপ্রকারেণ পুজোয় ছবি রিলিজের গুঁতোগুঁতি কিন্তু সে আমলে খুব ছিল না। কারণ বাংলা ছবির বক্স অফিসে জোয়ার তখন সংবৎসর জুড়েই। হিট ছবি সপ্তাহের পর সপ্তাহ হল-এ থাকত। তার সঙ্গেই পুজোর নতুন কী ছবি আসছে, তা নিয়ে আগ্রহটা জমা হত। বহু ক্ষেত্রে বড় রিলিজ শুরু হয়ে যেত মহালয়ার আশপাশ থেকেই। ১৯৬০-র মহালয়াতে যেমন এল ‘হসপিটাল’। পুজোয় ‘স্মৃতিটুকু থাক’ আর ‘শহরের ইতিকথা’। ১৯৬৬-তে বেশ কিছু দিন আটকে থাকার পরে মহালয়াতেই এল ‘গল্প হলেও সত্যি’। পুজোর সপ্তাহে ‘শঙ্খবেলা’। ১৯৬৮ আরও জমজমাট। মহালয়ার সপ্তাহে এসেছে ‘চৌরঙ্গী’। পুজোর সপ্তাহে ‘বালুচরী’ আর ‘অদ্বিতীয়া’।

আবার অন্য যে সব ছবি আগে থেকেই প্রেক্ষাগৃহে রমরম করে চলছে, তারা পুজোর জন্য বিশেষ বিজ্ঞাপন তৈরি করত। যেমন ১৯৬৮-র পুজোয় ‘বাঘিনী’ ছবির বিজ্ঞাপন, ‘দেবীর নামে নাম মেয়েটার, তাই বুঝি এত তেজ দুর্গার’! ১৯৭০-এর পুজোয় ‘মেঘ কালো’ ছবির বিজ্ঞাপনে শিউলি ফুলের মোটিফ দিয়ে লেখা হয়েছিল, ‘আমার ব্যথার পূজা হয়নি সমাপন’। ১৯৫২-র ‘বিন্দুর ছেলে’ ছবির জন্য পুজোর মরশুমে বইয়ের পাতা থেকে বেছে নেওয়া হয়েছিল লাইনটা, ‘মা আমার জগদ্ধাত্রী! বরও দেন, আবশ্যক হলে খাঁড়াও ধরেন!’

পুজোর ছবির খতিয়ান মেলাতে গিয়েই আবার উঁকি দিয়ে যায় অন্য ইতিহাস। ১৯৪৩-এর পুজোয় প্রমোদের প্রচার ম্লান হয়ে গিয়েছে মন্বন্তরে! নিরন্নকে অন্নদানের আহ্বানই তখন সবার আগে। ১৯৪৬-এ ‘বন্দেমাতরম’ ছবির সঙ্গে জুড়ে আছে, ‘অতীতের অন্ধকার থেকে ভবিষ্যতের আলোয় মনুষ্যত্বের মহত্তম আদর্শে’র কথা।’ ১৯৬৫ সালে যুদ্ধের কারণে নতুন ছবির মুক্তি বন্ধ ছিল কিছু দিন। পুজোতে গুমোট কাটল। পাঁচ-পাঁচটা ছবি। রাজা রামমোহন, সূর্যতপা, দোলনা, গুলমোহর, সুবর্ণরেখা।

ছবির এমন ঘনঘটা দেখেছিল ১৯৭৩-ও। শ্রীমান পৃথ্বীরাজ, শেষ পৃষ্ঠায় দেখুন, এক যে ছিল বাঘ, রৌদ্রছায়া, পদাতিক। ১৯৭১-এ মনে করা হয়েছিল, বাংলা-হিন্দি মিলিয়ে পুজোয় বুঝি এক ডজন ছবির রেকর্ড হবে। শেষ অবধি আসে দশটা। তার মধ্যে চারটে বাংলা। সীমাবদ্ধ, জয় বাংলা, খুঁজে বেড়াই, মহাবিপ্লবী অরবিন্দ। ১৯৭৫-এ পুজোর কিছু আগেই জরুরি অবস্থা জারি হয়েছে। সেই বাজারেও পুজোয় তিনটে বাংলা ছবি ছিল। প্রিয় বান্ধবী, সংসার সীমান্তে আর সন্ন্যাসী রাজা।

খেয়াল করা যাক, পুজোয় কিন্তু বাদ পড়ত না অন্য ধারার ছবিও। কিছু নাম আগেই উল্লেখ করেছি। এ ছাড়াও অপরাজিত, মহানগর, ভুবন সোম, কলকাতা ৭১, শতরঞ্জ কে খিলাড়ি...সবই পুজো রিলিজ। নতুন-পুরনো, মূলস্রোত-ভিনধারা, বাংলা-হিন্দি-ইংরেজি মিলিয়ে এ রাজ্যে সিনেমার তখন বিরাট সংসার। ছবি দেখানোর জায়গা এত সীমিত হয়ে পড়েনি! তার মধ্যেও গোলযোগ, অভাব-অভিযোগ ছিল না কি? অচলাবস্থা দেখা দিত মাঝেমধ্যেই। ১৯৬১-র পুজোতেই তো উত্তমকুমারের দু’-দু’টো ছবি আসার কথা। অথচ পুজোর দিন কাগজে বিজ্ঞপ্তি, ‘বাংলার প্রেক্ষাগৃহের মালিক ও কর্মিবৃন্দের বিরোধের জন্য বেঙ্গল মোশন পিকচার্স এসোসিয়েশনের কার্যকরী সমিতি তাঁহাদের সমুদয় সভ্যবৃন্দকে কোনও নূতন ছবি রিলিজ না করিবার নির্দেশ দেওয়ায় উক্ত ছবি দু’টি পূর্ব ঘোষিত ১৩.১০.৬১ হইতে রিলিজ করা সম্ভব হইল না।’

যে সে ছবি নয়, ‘দুই ভাই’ আর ‘সপ্তপদী’!

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy