Advertisement
E-Paper

‘যতটা হাসার কথা, হাসছে না’

সেই লালগড়, সেই আমলিয়া গ্রাম। গাছ ফেলে রাস্তা বন্ধ করে এক সময় দিনের পর দিন অবরুদ্ধ যে লালগড় দেখেছি, আজকের লালগড় দেখলে তা অবশ্য কল্পনা করাটাও কঠিন।

 ‘এনকাউন্টারে’ হত লালমোহন টুডুর ছবি হাতে ছেলে লিয়েন্ডার (বাঁ দিকে)। পোশাক বদল ছত্রধর মাহাতোর।

‘এনকাউন্টারে’ হত লালমোহন টুডুর ছবি হাতে ছেলে লিয়েন্ডার (বাঁ দিকে)। পোশাক বদল ছত্রধর মাহাতোর। নিজস্ব চিত্র।

তাপস সিংহ

শেষ আপডেট: ২৮ ফেব্রুয়ারি ২০২১ ০৬:৪২
Share
Save

বাঁ হাতে আয়না। ডান হাতে ধরা টুইন ব্লেড নিখুঁত ভাবে নেমে আসছে শেভিং ক্রিমের আস্তরণ ভেদ করে। সামনের উঠোনে জাবর কাটছে গোটা চারেক গরু। উঠোনের আর এক প্রান্তে সাবমার্সিবল পাম্পের অফুরান জলের ধারা। এই মধ্য ফাগুনেই রোদের আঁচ ধিকি ধিকি গায়ে লাগে। এ বাড়ির বাসিন্দা মৃদু হেসে বললেন, ‘‘একটু বসুন, গায়ে জলটা ঢেলেই আসছি।’’

উঠোনের চত্বরের বাইরেই তেঁতুলগাছের নীচে চেয়ার পাতা হয়েছে। ঠান্ডা বাতাসে কেমন ঝিমধরা কণা মেশানো। একটু আগের লুঙ্গি পরিহিত চেহারা উধাও। ধবধবে সাদা পাঞ্জাবি-পাজামা পরা ছত্রধর মাহাতো মৃদু হেসে বললেন, ‘‘বাঁকুড়ার ওন্দায় যাব, মিটিং আছে।’’

পুরনো বাড়ির মধ্যেই অপেক্ষায় সাদা এসইউভি। ছত্রধরের অবশ্য নতুন বাড়ি হচ্ছে কাছেই। সে বাড়ি নিয়ে ইতিমধ্যেই নানা প্রশ্ন উঠেছে বিরোধীদের মধ্যে। ছত্রধর যদিও বলছেন, ‘‘অনেক কষ্ট করে করতে হচ্ছে। টাকার অভাবে বাড়ি পুরো করতে পারিনি এখনও। ছেলে লোন নেবে বলছে।’’

এক সময় সন্ত্রাসদীর্ণ জঙ্গলমহলে ‘পুলিশি সন্ত্রাসবিরোধী জনসাধারণের কমিটি’র অন্যতম প্রধান মুখ ছত্রধর আজ জঙ্গলমহলে শাসকদল তৃণমূলেরও অন্যতম প্রধান মুখ। তৃণমূল নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁকে দলের অন্যতম রাজ্য সম্পাদক করেছেন। ছত্রধর বলছেন, ‘‘প্রতিটা ব্লকে ঘুরে ঘুরে সভা করছি। জনগণ সাড়াও দিচ্ছে।’’ তা হলে ২০১৯-এর লোকসভা ভোটে জঙ্গলমহল সাড়া দিল না কেন? ছত্রধর মনে করেন, ২০১১-র পর থেকে জঙ্গলমহলের প্রচুর উন্নতি হলেও আদিবাসীরা তাঁদের মর্যাদা পাননি। ‘‘আদিবাসীদের মনোভাব কেমন জানেন? আপনি যদি ওঁদের ঘরে গিয়ে দাঁড়ান, আপনি শত্রু হলেও ওঁরা আপনাকে গুড়-জল দিয়ে আপ্যায়ন করবেন। কিন্তু ক’জন এসেছেন ওঁদের ঘরে?’’

তা হলে কি ছত্রধর মনে করছেন না, জঙ্গলমহল হাসছে? ‘‘অবশ্যই মনে করি, জঙ্গলমহল হাসছে। কিন্তু কিছু নেতা বাইরে এই নিয়ে মাইকে প্রচার করলেও যতটা হাসার কথা ছিল ততটা হাসছে না।’’

সেই লালগড়, সেই আমলিয়া গ্রাম। গাছ ফেলে রাস্তা বন্ধ করে এক সময় দিনের পর দিন অবরুদ্ধ যে লালগড় দেখেছি, আজকের লালগড় দেখলে তা অবশ্য কল্পনা করাটাও কঠিন। ঝকঝকে রাস্তা, কংসাবতীর উপর সেতু, নার্সিং ট্রেনিং ইনস্টিটিউট, নিশ্চিন্তে ঘুরে বেড়ানো লালগড়ের এই বদলের ছোঁয়া কি ছত্রধরের মধ্যেও?

আগের ছত্রধর প্যান্ট-শার্ট পরতেন, আজকের ছত্রধর সাদা পাজামা-পাঞ্জাবি পরেন। আগে যে পুলিশ ও নিরাপত্তা বাহিনীকে আটকাতে কার্যত দুর্গে পরিণত হয়েছিল লালগড়, এখন সেই পুলিশ তাঁর নিরাপত্তা দেয়।

কেমন লাগে তাঁর? ছত্রধর হাসেন, ‘‘খুব অস্বস্তি হয় জানেন! আমি প্রথমে নিতে চাইনি। কিন্তু বাধ্য হয়েছি।’’

জঙ্গলমহল হাসে।

কাঁদেও!

এই আমলিয়া থেকে মাত্র তিন কিলোমিটার দূরেই। লালগড় থেকে রামগড় যাওয়ার পথে নাড়চা প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পাশের বাড়িটায় জোর গলায় ডাকা সত্ত্বেও প্রথমে কারও সাড়া পাওয়া যাচ্ছিল না। ‘লিয়েন্ডার...লিয়েন্ডার’ ডাকতে ডাকতে অনেক পরে যে মুখটা দরজা খুলল, সে মুখে রাগ-হতাশা আর বিতৃষ্ণা। ভূপতি... জনসাধারণের কমিটির তৎকালীন সভাপতি লালমোহন টুডুর ছোট ছেলে। বড় ছেলে লিয়েন্ডার একটু বেরিয়েছে।

সেই লালমোহন, যাঁর মৃত্যু হয় পুলিশি ‘এনকাউন্টার’-এ, নিজের বাড়িতেই। তাঁর বৃদ্ধা মা চেয়েছিলেন ছেলের মৃতদেহ যেন তাঁর হাতে দেওয়া হয়। কিন্তু বামফ্রন্ট সরকারের পুলিশ সেই অনুরোধে কান দেয়নি।

এই লালমোহন টুডুর সঙ্গেই সবসময় জুড়ে থাকত ছত্রধর মাহাতোর নামও। কিন্তু সেই ছত্রধরের নাম শুনেই ২২ বছরের ভূপতি বলে ওঠেন, ‘‘বড়পেলিয়া চকে সবাই একসঙ্গে বসত। অথচ, বাবা চলে গিয়েছেন জেনেও, ঠাকুমা অসুস্থ জেনেও তিনি এক বারও বাড়িতে আসেননি। এক বারও মায়ের খোঁজ নেননি। আমাদের এখন হাঁড়ি চলে না।’’

ঝাড়গ্রামের একটি স্কুলে গ্রুপ-ডি কর্মীর চাকরি পেয়েছেন ভূপতি। ওই কয়েক হাজার টাকায় কিচ্ছু হয় না তাঁদের। কথার মধ্যেই ফেরেন লিয়েন্ডার। বলেন, ‘‘ঠাকুমার ওষুধের খরচই মাসে চার-পাঁচ হাজার টাকা। কোথা থেকে পাব? মা বিধবা ভাতাও পায় না। আর কেউ কেউ জেল থেকে বেরিয়ে বড় নেতা হয়ে যান। আমাদের অবস্থা দেখার জন্য বাড়িতে আসার কথা বললে বলেন, ‘আমি গেলেই কি তোদের সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে?’ আর কিছু কি বলা যায় এর পর?’’

ঘরের ভিতর থেকে বাবা লালমোহনের ছবি এনে লিয়েন্ডার বলতে থাকেন, ‘‘বাবা চলে গিয়েছে ১০ বছরের বেশি। কিন্তু আমরা এখনও ঘুরে দাঁড়াতে পারিনি...’’, কান্না ছিটকে ওঠে লিয়েন্ডারের গলা থেকে। অন্ধকার দালান থেকে আরও অন্ধকার ঘরের ভিতর ঢুকে যেতে থাকে এক কান্নার অবয়ব।

Jangalmahgal Chatradhar Mahato Gram Darshan

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:

Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy

এটি একটি প্রিন্ট আর্টিক্‌ল…

  • এমন অনেক খবরই এখন আপনার হাতের মুঠোয়

  • সঙ্গে রোজ পান আনন্দবাজার পত্রিকার নতুন ই-পেপার পড়ার সুযোগ

  • ই-পেপারের খবর এখন শুধুই ছবিতে নয়, টেক্সটেও

প্ল্যান সিলেক্ট করুন

মেয়াদ শেষে নতুন দামে আপনাকে নতুন করে গ্রাহক হতে হবে

Best Value
এক বছরে

৫১৪৮

১৯৯৯

এক বছর পূর্ণ হওয়ার পর আপনাকে আবার সাবস্ক্রিপশন কিনতে হবে। শর্তাবলী প্রযোজ্য।
*মান্থলি প্ল্যান সাপেক্ষে
এক মাসে

৪২৯

১৬৯

এক মাস পূর্ণ হওয়ার পর আপনাকে আবার সাবস্ক্রিপশন কিনতে হবে। শর্তাবলী প্রযোজ্য।