শোভন চট্টোপাধ্যায় বেহালা এলাকারই কাউন্সিলর। তাৎপর্যপূর্ণ ভাবে তাঁকে মুখ্যমন্ত্রীর এ দিনের বৈঠকে ডাকা হয়নি। —ফাইল চিত্র।
বরফ গলানোর চেষ্টা চলছে অনেককে ময়দানে নামিয়ে। কখনও ফিরহাদ, কখনও পার্থ, কখনও আবার তাঁর ঘনিষ্ঠ হিসেবে পরিচিত কাউন্সিলরদের কাজে লাগিয়ে। কিন্তু কিছুতেই গলানো যাচ্ছে না দীর্ঘ দিনের রাজনৈতিক সঙ্গীর মন। অবশেষে সেই সঙ্গীর সঙ্গীদেরকেই ডেকে পাঠালেন মুখ্যমন্ত্রী তথা তৃণমূলনেত্রী। বৈঠক করলেন বিধানসভায়। কলকাতার প্রাক্তন মেয়রের রাজনৈতিক অবস্থান নিয়ে জল্পনা যখন তুঙ্গে, ঠিক তখনই এই বৈঠক হওয়ায় গুঞ্জন শুরু হয়েছে তৃণমূলের নতুন কোনও সম্ভাব্য কৌশল নিয়ে।
১৯ জন কাউন্সিলরকে নিয়ে যে শুক্রবার মুখ্যমন্ত্রী বৈঠকে বসবেন বিধানসভায়, বৈঠকটি হওয়ার ২৪ ঘণ্টা আগেও তা কারও জানা ছিল না। বৃহস্পতিবার রাতের দিকে হঠাৎ বেহালা এলাকার সব কাউন্সিলরকে তলবের সিদ্ধান্ত হয় বলে তৃণমূল সূত্রের খবর। শুক্রবার বিধানসভায় পৌঁছনোর পরে মুখ্যমন্ত্রী প্রথমে অধিবেশনে যোগ দেন। পরে অধিবেশন কক্ষ থেকে বেরিয়ে নিজের ঘরে ডেকে নেন কাউন্সিলরদের। বেহালা এলাকায় দল তথা সংগঠনের পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনায় বসেন।
তৃণমূল সূত্রের খবর, জনসংযোগ বাড়ানোর নির্দেশ দিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী। বেহালা এলাকায় সংগঠনের কাজ দেখভালের মূল দায়িত্ব এখন থেকে কাদের উপরে থাকবে, তা তৃণমূলনেত্রী নির্দিষ্ট করে দিয়েছেন। অভিজিৎ মুখোপাধ্যায়, তারক সিংহ, সুশান্ত ঘোষ এবং অশোকা মণ্ডল— এই ৪ কাউন্সিলরকেই গোটা এলাকা দেখভালের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। বৈঠকে উপস্থিত বাকি ১৫ কাউন্সিলরও ওই ৪ জনের সঙ্গেই যোগাযোগ রেখে চলবেন, এমন নির্দেশই দেওয়া হয়েছে বলে খবর। তবে এই বৈঠক নিয়ে মুখ্যমন্ত্রী নিজে কোনও মন্তব্য করেননি। কাউন্সিলরদেরও প্রকাশ্যে কোথাও কিছু বলতে দেখা যায়নি।
আরও পড়ুন: গ্রেফতার করুন অর্জুনকে, ভাটপাড়ায় গিয়ে পুলিশকে চাপ ববির, পাল্টা চ্যালেঞ্জ সাংসদের
বিধানসভা সূত্রের খবর, মুখ্যমন্ত্রী এ দিন খুব ভাল মেজাজেই বৈঠক করেন বেহালার কাউন্সিলরদের সঙ্গে। বার বার একজোট হয়ে কাজ করার পরামর্শ দেন। কোনও সমস্যা হলে সরাসরি তাঁকেও জানানো যেতে পারে, এমন কথাও মুখ্যমন্ত্রী বলেন বলে খবর। বেহালা তাঁর ‘মনের কাছের’ জায়গা এবং তাঁর রাজনৈতিক জীবনের অনেক ‘গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্তের’ সাক্ষী বেহালা— মুখ্যমন্ত্রী এ দিন কাউন্সিলরদের এমনও বলেন বলে খবর। দলীয় কাউন্সিলরদের প্রতি তাঁর বার্তা— বেহালা যেন বিচ্ছিন্ন না থাকে।
কিন্তু বেহালার বিচ্ছিন্ন থাকার প্রশ্ন উঠছে কেন? বেহালা পূর্বের বিধায়ক শোভন চট্টোপাধ্যায় এবং তিনি বেশ কয়েক মাস ধরে দলের সঙ্গে বিস্তর দূরত্ব বহাল রেখে চলছেন, সে কথা ঠিক। কিন্তু বেহালা পশ্চিমের বিধায়ক পার্থ চট্টোপাধ্যায় তো স্বমহিমাতেই দলে ও সরকারে রয়েছেন এখনও। শোভনের অনুপস্থিতিতে পার্থ তো সামলে নিতে পারতেন পরিস্থিতি? পার্থ কি সামাল দিতে পারছেন না? যদি পারেন, তা হলে কেন খোদ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে বৈঠকে বসতে হল? এই সব প্রশ্ন ঘুরতে শুরু করেছে রাজনৈতিক শিবিরে।
আরও পড়ুন: ভাটপাড়ায় তৃণমূলের প্রতিনিধি দল, বাড়ি বাড়ি ঘুরে কথা বাসিন্দাদের সঙ্গে
শোভন চট্টোপাধ্যায় যত দিন মেয়র পদে ছিলেন, তত দিন বেহালা তো বটেই, কলকাতার অন্যান্য এলাকার কাউন্সিলরদের সঙ্গেও দেখা করার প্রয়োজন হয়নি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের। এখন কী এমন হল যে, কাউন্সিলরদের ডেকে পাঠিয়ে খোদ মুখ্যমন্ত্রীকে বৈঠকে বসতে হল? প্রশ্ন শোভনের ঘনিষ্ঠদের।
শোভন চট্টোপাধ্যায়ের অনুপস্থিতি বেহালায় তৃণমূলের সংগঠনকে সাংঘাতিক ভাবে দুর্বল করেছে বলে তৃণমূলের একটি অংশই মনে করছে। তাই শোভনকে আবার পুরনো ভূমিকায় ফিরে পেতে তৃণমূল নেতৃত্ব এখন আগ্রহী বলে খবর। শোভন চট্টোপাধ্যায় বিজেপিতে যেতে পারেন, এই জল্পনা তৈরি হওয়ার পরে তৃণমূল আরও উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছে। সামনের বছর কলকাতা পুরসভার নির্বাচন। এ বারের লোকসভা নির্বাচনে কলকাতার ৫০ ওয়ার্ডে বিজেপি এগিয়ে গিয়েছে। এর পরে শোভন যদি সত্যিই বিজেপিতে যান, তা হলে পরিস্থিতি কী হতে পারে, তা বুঝতে তৃণমূল নেতৃত্বের অসুবিধা হচ্ছে না মোটেই। সেই কারণেই বেহালার কাউন্সিলরদের ডেকে বৈঠকে বসতে হল বলে শোভন ঘনিষ্ঠদের দাবি।
আরও পড়ুন: ‘তথ্য বিকৃতি’র অভিযোগ এনে তিনটি বাংলা দৈনিকের বিরুদ্ধে শাসক দলের নোটিস
শোভন চট্টোপাধ্যায় নিজেও কিন্তু বেহালা এলাকারই কাউন্সিলর। তাৎপর্যপূর্ণ ভাবে তাঁকে কিন্তু এ দিনের বৈঠকে ডাকা হয়নি। শোভনের ঘনিষ্ঠ বৃত্তে থাকা লোকজন অন্তত তেমনই বলছেন। বৈঠকে তৃণমূলনেত্রী কিন্তু শোভন সম্পর্কে কোনও বিরূপ মন্তব্য এ দিন করেননি। বিধানসভা সূত্রের খবর অন্তত তেমনই। বরং কয়েক জন কাউন্সিলরকে শোভনের সঙ্গে যোগাযোগ রেখে চলার বার্তাই দেওয়া হয়েছে বলে খবর।
তবে বেহালার কাউন্সিলরদের সঙ্গে দলনেত্রীর এই বৈঠককে শোভন ঘনিষ্ঠরা যে খুব একটা ইতিবাচক চোখে দেখছেন না, তা স্পষ্ট হয়ে গিয়েছে বৈশাখী বন্দ্যোপাধ্যায়ের মন্তব্যে। শুক্রবার আনন্দবাজারকে বৈশাখী বলেন, ‘‘তৃণমূলের কি আদৌ কোনও নির্দিষ্ট নীতি রয়েছে? কখনও শোভন চট্টোপাধ্যায়কে আবার তৃণমূলের হয়ে সক্রিয় হওয়ার প্রস্তাব পাঠানো হচ্ছে, বার বার অনুরোধ করা হচ্ছে। কখনও আবার সে দলের নেত্রী বেহালার তৃণমূল কাউন্সিলরদের বৈঠকে ডাকছেন, কিন্তু শোভন চট্টোপাধ্যায় সে বৈঠকে ডাক পাচ্ছেন না।’’ বৈশাখীর প্রশ্ন, ‘‘তা হলে কি দলনেত্রী ধরেই নিয়েছেন যে, শোভন চট্টোপাধ্যায় আর তৃণমূলে নেই?’’ কটাক্ষের সুরে বৈশাখী বন্দ্যোপাধ্যায়ের মন্তব্য, ‘‘এখন তো মনে হচ্ছে, তৃণমূলের শীর্ষ নেতৃত্ব বুঝতেই পারছেন না যে, শোভন চট্টোপাধ্যায় সম্পর্কে তাঁদের কী অবস্থান নেওয়া উচিত!’’
শোভনের গতিপ্রকৃতির দিকে যে তৃণমূল নেতৃত্ব সতর্ক নজর রেখে বসে রয়েছেন, তা দলে প্রায় কারও অজানা নয়। বেহালা এবং দক্ষিণ কলকাতার বেশ কিছু ওয়ার্ডে শোভন চট্টোপাধ্যায়ের প্রভাব যে অবজ্ঞা করার মতো নয়, তা তৃণমূল জানে। এই মুহূর্তে রাজ্যে বিজেপির পালে হাওয়ার বহর যে রকম, তাতে শোভন সেই শিবিরে গেলে যে তাঁর ওজন আরও বেড়ে যাবে, সে-ও রাজ্যের শাসক দলের নেতৃত্ব বুঝতে পারছেন। সেই কারণেই শোভনকে নিয়ে সিদ্ধান্তে পৌঁছতে নেতৃত্বের সমস্যা হচ্ছে বলে রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের মত। সেই দ্বিধা থেকেই শোভনকে নিয়ে যে কোনও সিদ্ধান্তে পৌঁছনোর পথ খোলা রাখা হচ্ছে বলে পর্যবেক্ষকরা মনে করছেন। এক দিকে দলের প্রথম সারির নেতাদের তরফ থেকে বার বার বার্তা পাঠিয়ে শোভনের মানভঞ্জনের চেষ্টা চালানো হচ্ছে। অন্য দিকে খোদ দলনেত্রী শোভন ছাড়া বেহালা এলাকার অন্য সব তৃণমূল কাউন্সিলরদের নিয়ে বৈঠক করে নিশ্চিত করতে চাইছেন যে, শোভন শেষ পর্যন্ত হাতছাড়া হয়ে গেলেও, শোভনের ঘনিষ্ঠ হিসেবে পরিচিত কাউন্সিলররা যাতে হাতেই থাকেন। সেটুকু করা গেলেও ড্যামেজ অনেকটা কন্ট্রোলে থাকবে বলে তৃণমূলের একাংশ মনে করছেন।
এবার শুধু খবর পড়া নয়, খবর দেখাও। সাবস্ক্রাইব করুন আমাদের YouTube Channel - এ।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy