Advertisement
২৩ নভেম্বর ২০২৪

মায়া মাছের মতো তার হাতছানি

পাল্টা তেরিয়া হওয়ায় জৈষ্ঠের আকাশে মেঘ জমল ভেবে মাটি থেকে মাথা তুলে ইস্রাইল আড়চোখে দেখে, মেয়েটা চুপ করে আছে। শালুক পাতায় স্তব্ধ ভোরের বৃষ্টি-বিন্দুর মতো তার নাকের পাটায়  দু’ফোঁটা ঘাম।

রাহুল রায়
শেষ আপডেট: ২১ জুলাই ২০১৯ ০২:১২
Share: Save:

খোলা জমিতে খান তিনেক শিরীষ গাছ একটা ছায়ার উঠোন তৈরি করেছে। তার পর বীজতলা বোনা অফুরান সবুজ মাঠ।

নাবাল সেই ছায়ায় হাত কোদালটা রেখে সাহস করে প্রশ্নটা করেই বসে ইস্রাইল—

তুমার ঘর কুথায় গো?

—ইঃ, সব তো জ়ান, আবার ঢঙ করত্যাস ক্যান!

কান ঘেঁষে রোদ্দুরে সেঁকা উত্তরটা উড়ে আসতেই একটু থতমত খায় ইস্রাইল। মিনমিন করে বলে, তুমায় রোজ দেহি, এইডুহুই....ঘরবসত জ়ানব ক্যামনে...

শিরীষের ছায়াছন্নতায় কাঠ-কাঠ মুখঝামটায় বেসামাল ইস্রাইল পায়ের বুড়ো আঙুল দিয়ে নরম মাটিতে ইকিরমিকির দাগ কাটে। কথা কি আর বাড়াবে, মনে মনে ভাবে। প্রশ্নটা এ বার সহসা ও দিক থেকে ফিরে আসে—

মিঁয়ার কয় কাডা জ়মি এই হানে?

ভাগের জমিতে নিড়ান দেওয়া ইস্রাইল মরিয়া হয়ে বলে--

তা আসে কিস্যু...তুমার তাতে কাম কি হুনি?

পাল্টা তেরিয়া হওয়ায় জৈষ্ঠের আকাশে মেঘ জমল ভেবে মাটি থেকে মাথা তুলে ইস্রাইল আড়চোখে দেখে, মেয়েটা চুপ করে আছে। শালুক পাতায় স্তব্ধ ভোরের বৃষ্টি-বিন্দুর মতো তার নাকের পাটায় দু’ফোঁটা ঘাম। ফর্সা কপালে এক মুঠো এলোমেলো চুল। দমকা হাওয়ায় আজ অগোছাল সেই ঘোমটাটাও নেই। চোখ নামিয়ে নেয় ইস্রাইল। কথা আর এগোয় না। আলের পাশে পড়ে থাকা তোবড়ানো ডিব্বা আর ম্লান হয়ে আসা একদা সবুজ জলের বোতলটা গুছিয়ে নিতে থাকে।

খুব ফিঙে ডাকছে আজ। আর খানিক পরেই পড়ে আসবে বেলা, তার পর, নালা-বিল-মাঠ ঠেঙিয়ে তার স্বদেশে ফিরে যাওয়া।

গোড়ালি ডোবা দু’টো মরা সোঁতা আর মাথা ঝুঁকিয়ে কাত হয়ে দু’দেশের সীমানা এঁকে দেওয়া খান কয়েক হলুদ পিলার। তার পর উদোম ন্যাড়া মাঠ, চর পরাশপুরের বালককুল যে ডাঙায় বিকেলের মরা আলোয় বাতাবি লেবু নিয়ে ফুটবল খেলে।

—জ়াওয়ার আগি এক বার বলতি অয়, মিয়াঁ কি সেই ডুহুনও জ়ানে না!

শিরীষের ছায়াটুকু পিঠ থেকে সরে যাওয়ার আগে পিছন থেকে উচ্ছ্বল ফিঙের মতো উড়ে আসে চিমটিটা। জ্যোৎস্নার পদ্মায় যেন ঘাই মারে ইলিশ! ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে ইস্রাইল, আল ভেঙে আতারপাড়ার দিকে ফিরে যাচ্ছে সে। ফিরে যাওয়ার আগে এক বার বলে আসা উচিত ছিল সত্যিই, তীব্র আফসোস নিয়ে বিকেল ফুরিয়ে আসছে। ইস্রাইল মাথা নীচু করে গ্রামের পথ ধরে।

চরের কাদায় আর কাঁটায় চব্বিশটা বছর পেরিয়ে গেল তার। আতারপাড়া গ্রামটা এমন দূরের তো মনে হয়নি কখনও। আজকাল কি এক আড়ষ্ঠতায় বড় সুদূর মনে হয়, আর হয় বলেই মাঠ থেকে কোদাল-খুরপি, নিড়ান গোয়ালের পাশে ছুঁড়ে দিয়ে ইস্রাইল ফিরে আসে এবরোখেবড়ো সেই ডাঙার প্রান্তে উঁচু ঢিপিটার উপরে।

হাতের তেলো দিয়ে ছাউনি করে ও পাড়ের গ্রামটাকে চুপ করে দেখে। খান কয়েক বাবলার ছায়া পিঠে নিয়ে একটা সরু লিকলিকে রাস্তা গ্রামের গভীরে সেঁদিয়ে গেছে। বাকিটুকু দেখা যায় না। ইস্রাইল অবশ্য চোখ বুজে বলে দিতে পারে—রাস্তার মুখেই পাঁচিল ভাঙা মসজিদ তারপর আহম্মদদের বাড়ি, পেয়ারা বাগান, বাংলাবাজারের আটপৌরে আব্বাস টেলারের সাইনবোর্ড... হুবহু মনে আছে তার। ছেলেবেলায় ওই পথে ফুটবল, পেয়ারা চুরি, এক্রামের দোকানে চানাচুর...। বছর কয়েক হল সেই সব অনায়াস চলাচলে অনুশাসনের চোখ রাঙানি শুরু হয়েছে। না হলে কবেই ‘এই এড্ডু দেখতি এলাম’ বলে তার ঘরবসত ঠিক ছুঁয়ে আসত।

ঢিপির উপরে বসে এলোমেলো ভাবে ইস্রাইল, সব কেমন দ্রুত বদলে যাচ্ছে, পদ্মার স্রোত, ইলিশের আনাগোনা, চরের বালি, সারের কোয়ালিটি...নিজের মনখানাও কেমন চায়ে ডোবা থসথসে বিস্কুটের মতো হয়ে গেছে আজকাল।

ঝুপ করে আঁধার নামল। ও পাড়ের বিওপি’তে বিউগল বাজে। সেই প্রথম সাঁঝের অন্ধকারে আতারপাড়া গ্রামখানা মায়া-মাছের মতো দুর্নিবার এক হাতছানি হয়ে, সবুজ পাড়, কালো মলিন একটা শাড়ি পড়ে শিরীষ ছায়ায় দাঁড়িয়ে থাকে।

অন্য বিষয়গুলি:

Char Parashpur Border India Bangladesh
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy