আলি আকবর খান, চতুর লাল এবং রবিশঙ্করের সঙ্গে।
১৯৪৯-এ আমি কোথায়, তা একটু ভাবতে হল। কারণ, জীবনে এত বেশি ঠাঁইনাড়া হলে চট করে মনে পড়া কঠিন। যত দূর মনে হয়, জলপাইগুড়িতে কোনও একটা সিনেমা হলে সদ্য মুক্ত ‘মহল’ ছবিটা দেখেছিলাম। ভুতুড়ে আর রহস্যময় গল্প। অশোককুমার আর মধুবালার আশ্চর্য ছবি। কিন্তু ছবি নয়, যে সম্মোহনটা নিয়ে ফিরলাম, তা একটা গানের। ‘আয়েগা আনেওয়ালা’। গায়িকা নতুন, তাঁর নাম আগে কখনও শুনিইনি। লতা মঙ্গেশকর। আশ্চর্য সরু, সুরেলা আর মিঠে এক অতিলৌকিক কণ্ঠস্বর। অপ্রাকৃত বললেও ভুল হয় না। কোনও মানুষের যে ও রকম আশ্চর্য কণ্ঠস্বর হতে পারে, তা না শুনলে বিশ্বাসই হত না। প্রকৃতপক্ষে ও রকম গলা অর্জনসাপেক্ষ তো নয়, প্রকৃতিদত্ত। ওই কণ্ঠস্বরের জাদুতেই ‘মহল’ সুপার-ডুপার ব্যবসা করে ফেলেছিল। আর তখনকার দিনে সোশ্যাল মিডিয়া বা টেলিভিশন চ্যানেল না থাকলেও পথেঘাটে এবং সর্বত্র লোকজনের সুরেলা বা বেসুরো কণ্ঠে ‘আয়েগা, আয়েগা’ শোনা যেত। কত যে নকল আর প্যারোডি হয়েছিল, তার ইয়ত্তা নেই। সেই আমলের ‘ভাইরাল’ বলা যেতে পারে। ওই একটা গানেই গায়িকা নিজের জাত চিনিয়ে দিয়েছিলেন।
এক সাক্ষাৎকারে লতা বলেছিলেন, গানটা প্রথমে দূর থেকে শোনা যাবে এবং ক্রমে কাছে আসবে বলে তাঁকে শুরু করতে হয়েছিল মাইক্রোফোনের অনেক দূরে দাঁড়িয়ে, তার পরে আস্তে আস্তে হেঁটে মাইক্রোফোনের কাছে আসতে হয়েছিল। এ সব এফেক্ট আজকাল যন্ত্রের মাধ্যমেই হয়, কিন্তু সেই আমলে যন্ত্রের বদান্যতা তো ছিল না, তাই ওই কায়ক্লেশ। লতা বলেছিলেন, ওই ভাবে হেঁটে হেঁটে গান গাইতে তাঁর খুব অসুবিধে হয়েছিল। দম পাচ্ছিলেন না। তাতেও একটা গানেই পুরো দেশটার এ মুড়ো-ও মুড়ো ভাসিয়ে দিয়েছিলেন অনায়াসেই।
জন্মদত্ত কণ্ঠস্বর তো ছিলই, তার উপরে তাঁর আশ্চর্য গায়কী! সুরের উথালপাথাল তাঁর কণ্ঠে। তাই তাঁর গানের জাদুতেই অনেক ছবি হিট হয়ে যায়। সম্ভবত গান নিয়ে আলাদা জীবন কাটাবেন বলে তিনি মনস্থির করতে পারেননি, সংসারের অভাবের কারণে। পিতা দীননাথ মঙ্গেশকর যখন মারা যান, লতার বয়স তেরো। সংসার সামলাতে গান গাইতেন, অভিনয় করতেন। প্লেব্যাক না করেও তাঁর উপায় ছিল না। কিশোরী লতাকে পায়ের নীচে শক্ত মাটি পেতে অনেক লড়াই করতে হয়েছে। উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতে নিবেদিতপ্রাণ হলে সংসার যে ভেসে যায়। ফলে তাঁকে ফরমায়েশি গানের জগতে থাকতেই হল। অন্যের সুরে, অন্যের নির্দেশিত ভঙ্গিমায় দিনের পর দিন অজস্র গান গেয়ে যেতে হল। পরে ওটাই তাঁর রুজি-রুটি ও প্যাশন হয়ে গেল। তা বলে ধ্রুপদী তালিম বাদ দেননি। কিন্তু সেই ধ্যান দিতে পারেননি। তবে লোকপ্রিয় গানের যে মায়াজগৎ, যে অফুরাণ শ্রবণসুখের প্রস্রবণ খুলে দিলেন তিনি, তারই বা তুলনা কোথায়!
‘উয়ো কৌন থি’ ছবিতে একটা গান ছিল ‘লাগ যা গলে...’। একটি আদ্যন্ত রোম্যান্টিক গান, যা লতার গলায় এমন মাত্রা পেয়েছিল, যাতে মনে হয়, এটাই পৃথিবীর শেষ গান। কিংবা ‘এক প্যায়ার কা নগমা হ্যায়’ কিংবা ‘নয়না বরসে’ কিংবা বাংলায় ‘আর কিছু তো নাই’, ‘আকাশপ্রদীপ জ্বলে’, ‘নিঝুম সন্ধ্যায়’ বা ‘কেন কিছু কথা বলো না’। ওই মনে হবে, এর পরে আর গান হয় নাকি! সলিল চৌধুরীকে খুব বড় এবং বৈচিত্রময় সুরকার হিসেবে মানতেন। সলিল চৌধুরীর সুরে বিস্তর গান গেয়েছেন। বাংলায় গান গাইবেন বলে বাসু ভট্টাচার্যের কাছে রীতিমতো বাংলা লিখতে এবং পড়তে শিখেছেন। আর হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, শচিনদেব বর্মণ, রাহুলদেব বর্মণ কিংবা কিশোরকুমারের সুরে তো বিস্তর গান আছেই। তাঁর বাংলা গানের উচ্চারণ এতই নিখুঁত যে, লতাকে মরাঠি বলে মনেই হত না। দেশি ও বিদেশি ছত্রিশটিরও বেশি ভাষায় তাঁর গাওয়া আছে। শেষ কয়েকটা বছর বাদ দিলে তাঁকে সারাটা জীবনই বিরামহীন ভাবে গেয়ে যেতে হয়েছে। গানের প্রতি যতিহীন, আপসহীন ভালবাসা ছিল বলেই পেরেছেন। আর শুধু তো প্লেব্যাকই নয়, দেশে-বিদেশে অজস্র অনুষ্ঠানে কি বড় কম গাইতে হয়েছে!
বিয়ে কেন করলেন না, তা নিয়ে অনেক গুজব আছে। সেগুলো বেশির ভাগই বানানো। করেননি, করার প্রয়োজন বোধ করেননি বলেই। পরের প্রজন্মের গায়ক-গায়িকারা তাঁকে মাতৃসমা মনে করেন। মাতৃসমা মনে করেন সচিন তেন্ডুলকর এবং আরও অনেকে। এই মা-মা ভাবটা তাঁর কথায়-বার্তায় প্রকাশ পেত। আর একটা স্বতঃস্ফূর্ত দীনতা ও বিনয়। একটি অনুষ্ঠানে গান গাওয়ার পরে পাশে বসা হৈমন্তী শুক্লকে প্রশ্ন করেছিলেন, ‘‘ঠিকঠাক গেয়েছি তো?’’
তাঁর আমলে গীতা দত্ত ছিলেন এক মাদক ও সম্মোহক কণ্ঠস্বরের গায়িকা। লতা না থাকলে গীতা দত্তই হতেন সুরসম্রাজ্ঞী। কাছাকাছি ছিলেন সামসাদ বেগমও। কিংবা লতার সহোদরা আশা ভোঁসলে। কিন্তু সবাইকে ছাপিয়ে লতা অবিসংবাদী। তাঁর আর এক দূরের প্রতিদ্বন্দ্বী বাংলার সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়। সন্ধ্যা যখন ‘অগ্নিপরীক্ষা’ ছবিতে তাঁর অবিশ্বাস্য কণ্ঠে ‘গানে মোর কোন ইন্দ্রধনু’ গাইলেন, তখন আমরা বাংলার লতা মঙ্গেশকরকে পেয়ে গিয়েছিলাম। সন্ধ্যা আসলে ধ্রুপদী গানের শিল্পী। তাঁর খেয়াল-ঠুংরি আমি শুনেছি। বড়ে গোলামের প্রিয় শিষ্যা ছিলেন। আর লতার সঙ্গে তাঁর ব্যক্তিগত সংযোগও খুব মধুর ছিল বলে শুনেছি। প্রায় সমবয়স্কা এই দু’জন প্রতিদ্বন্দ্বী নন, বরং পরস্পরের পরিপূরক। সন্ধ্যা মুম্বই গেলে সর্বভারতীয় খ্যাতি পেতেন অবশ্যই। কিন্তু তিনি সেই চেষ্টাই করেননি।
লতা অজস্র পুরস্কার পেয়েছেন, কিন্তু পুরস্কার আর কাকে কবে নন্দিত করেছে! শেষ অবধি এই যে দেশবাসী তাঁর প্রয়াণে চোখের জল ফেলছে, যে কোনও শিল্পীর কাছে এটাই হল শ্রেষ্ঠ পুরস্কার। এই পুরস্কার যিনি পান, মরণ তো তাঁর কাছে শ্যামসমান।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy