শেখ শাহজাহান। — ফাইল চিত্র।
‘‘এই যে বাড়িগুলো দেখছেন, সব আমাদের জমি কেড়ে নিয়ে তৈরি।’’
আঙুল তুলে তিনি দেখাচ্ছিলেন নতুন নির্মাণগুলি। সন্দেশখালি ফেরিঘাট থেকে সামান্য এগিয়ে এডিএ (সহ-কৃষি অধিকর্তা) অফিসের উল্টো দিক দিয়ে যে রাস্তা চলে গিয়েছে দ্বীপের মধ্যেকার গ্রামগুলিতে, সেই পথ ধরে সামান্য এগোলেই এই নতুন নির্মাণগুলি। যার শেষে শিবপ্রসাদ হাজরার ‘অফিস’। যে অফিসে দিন নেই, রাত নেই, ডাকা হত মহিলাদের। এবং যে অফিসে এখন তালা। বাইরে কালো কাচ ভেঙে পড়ে আছে। ‘জনরোষের’ চিহ্ন। এত দিনেও কেউ পরিষ্কার করেনি।
সেই প্রৌঢ়া প্রথমে মুখ খুলছিলেন না। শেষে নাম-পরিচয় প্রকাশ না করার আশ্বাসে বাড়িগুলি দেখালেন। শিবুর অফিসঘরের শেষে যে ফাঁকা জমি, তার পিছনে দেখা যাচ্ছিল একটি পুকুর। তারও পরে আর একটি বাড়ি দেখিয়ে মহিলা বললেন, ‘‘ওই যে দেখুন থানা। পুলিশকে জানিয়েছিলাম। কিন্তু ওরা কিছুই করেনি।’’
সন্দেশখালির অন্দরে যত এগিয়েছি, ততই দু’টি বিষয় স্পষ্ট হয়ে গিয়েছে। এক, মহিলাদের অভিযোগ শোনার পরে বোঝা গিয়েছে, কেন তাঁদের নাম উল্লেখ করা কঠিন। একে তো অত্যাচারের অভিযোগ রয়েছে বেশির ভাগের মুখেই। তা ছাড়া রয়েছে নিরাপত্তার বিষয়টিও। যে ‘শাসনতন্ত্র’ শেখ শাহজাহান গোটা দ্বীপ জুড়ে চালাত বলে অভিযোগ, তার যন্ত্রীরা সকলেই যে পুলিশের জালে পড়েছে, এমন নয়। অনেকের বিশ্বাস, জেল থেকেই এদের মাধ্যমে এলাকায় নিজের শক্তি কায়েম রাখবে শাহজাহান। দুই, পুলিশের প্রতি অবিশ্বাস। ওই প্রৌঢ়া মহিলার মতো অনেকেই এই নিয়ে সরব। বলেছেন, পুলিশকে জানালে কিছু তো করবেই না, উল্টে যার বিরুদ্ধে অভিযোগ, তাকেই বিচারের দায়িত্ব দেবে।
হ্যাঁ, এমন ‘বিচার ব্যবস্থার’ কথাই উঠে এসেছে সন্দেশখালির এলাকায় ঘুরতে ঘুরতে। তা সে ৮ নম্বর কর্ণখালি হোক বা পুকুর পাড়া, পাত্র পাড়া হোক বা কলোনি পাড়া।
ফাল্গুনের সকালে ৮ নম্বর কর্ণখালিতে দাঁড়িয়ে প্রাণ জুড়িয়ে যাওয়ার কথা। পথের এক ধারে কয়েকটি বাড়ি। যেগুলির কোনওটি পাকা, কোনওটির মাথায় ত্রিপল। অন্য দিকে, গোয়ালঘর আর তা পেরিয়ে পরের পর জলাশয়।
এখানে দাঁড়িয়েই সেই মেয়েটি বলছিলেন, কী ভাবে শ্বশুরবাড়িতে তাঁকে পড়তে হয়েছিল আক্রমণের মুখে। শ্বশুরমশাই তৃণমূলেরই এক জন সদস্য। এবং এলাকায় তাঁর ভাবমূর্তি শাহজাহান ও তার ঘনিষ্ঠদের থেকে উজ্জ্বল বলেই আগে শোনা গিয়েছিল। অথচ মেয়েটির অভিযোগ, টাকা-পয়সা দেওয়ার চাপে সেই পরিবারই পুত্রবধূকে দিনের পর দিন অত্যাচার করেছে। মেয়েটি বলছিলেন, ‘‘এক দিন বরের সঙ্গে কথা কাটাকাটি হচ্ছিল। হঠাৎ পকেট থেকে বন্দুক বার করে কোমরে ঠেকিয়েছিল। একটা করে গুলি হয় তাতে। আমি বলেছিলাম, গুলি চালিয়ে দাও! না হয় মরে যাব।’’ তার পরে? মেয়েটি বললেন, ‘‘ওর মা ছুটে এসে আটকেছিলেন।’’
তা হলে এমন বন্দুক ওদের বাড়িতে আরও ছিল? মেয়েটি জানালেন, তিনি এর বেশি দেখেননি। তবে কোদালের বাট থেকে শুরু করে যাবতীয় ডান্ডা বাড়িতে মজুত থাকত। তাঁর সঙ্গে দাঁড়িয়ে কথা বলছিলেন যাঁরা, তাঁরা শোনালেন— পুলিশ যে লাঠি দিয়ে পেটায়, তাও অনেক সময় শাহজাহানের লোকজনের হাতে দেখা গিয়েছে। কেউ ‘শাসন না মানলে’ ওই লাঠিসোঁটা দিয়েই ঠেঙানো হত তাঁদের। মেয়েরা প্রশ্ন করেন, “বলুন তো, পুলিশের লাঠি ওদের কাছে আসে কী করে!”
পুলিশকে জানাননি? মেয়েটি বলেন, “কাজ হয়নি। তখন আমায় বিচার দিতে বলা হয়।” জানা গেল, তিন জন প্রবীণ পার্টি কর্মীর কমিটির সামনে কয়েক বার বিচার চেয়েছেন তিনি। কিন্তু তাঁরা সব কিছু বুঝেও এর সুরাহা করতে পারেননি।
এমন ‘বিচার ব্যবস্থার’ আরও নিয়মকানুন ছিল। যেমন, এলাকায় কিছু ঘটলে সোজা শাহজাহানের কাছে যাওয়া যেত না। আগে শিবপ্রসাদের কাছে যেতে হত। এই সব এলাকা থেকেই মহিলা-পুরুষ নির্বিশেষে জানালেন সে কথা। রীতিমতো এলাকা এবং দায়িত্ব ভাগ করে দেওয়া ছিল অনুগামীদের মধ্যে। শিবপ্রসাদ যেমন সন্দেশখালিতে। তেমনই শাহজাহানের ভাই সিরাজউদ্দিন ছিল বেড়মজুর ১-এ। উত্তম সর্দার আবার শিবপ্রসাদের অনুগামী। তার পরেও ছিল আমির আলি গাজি। এলাকায় ‘কাজকর্ম’ চলত এই ভাবে।
তা হলে কি পুলিশের শাসন ছিল না এলাকায়?
সন্দেশখালি জুড়ে এর নেতিবাচক জবাবই মিলেছে। অনেকে আবার বলেছেন, পুলিশের কাছে অভিযোগ করলে তার সুরাহায় পাঠানো হত এমন লোকের কাছে, হয়তো তার বিরুদ্ধেই অভিযোগটি করা হয়েছে। তার পরে হাত উল্টে তাঁরা মন্তব্য করেছেন, “ফলে বুঝতেই পারছেন, অবস্থা কী দাঁড়াত।”
এসডিপিও মিনাখাঁ আমিনুল ইসলাম খান বলেন, “ব্যক্তিগত ভাবে আমার কাছে যখন যাঁরা এসেছেন, আমি সাহায্য করেছি।” কিন্তু থানায় গেলে? তাঁর কথায়, “থানায় গেলে কাজ হচ্ছে না, এমন যদি কারও মনে হয়, তা হলে জেলা পুলিশের যে কোনও পদাধিকারীর কাছে গেলেই প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ হবে।”
স্থানীয়দের প্রশ্ন, তা হলে শাহজাহান ও তার বাহিনীর বিরুদ্ধে এত ক্ষোভ জমল কী ভাবে?
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy