স্মৃতি: প্রণব মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে সোমেন মিত্র। নদিয়ায়। ফাইল চিত্র
নব্বইয়ের দশক। উত্তর ২৪ পরগনায় দলের মিটিংয়ে যাবেন বলে তৈরি হচ্ছেন কংগ্রেস নেতা সোমেন মিত্র। আমহার্স্ট স্ট্রিটের বাড়িতে অনুগামীদের ভিড়।
তারই মধ্যে হইহই করতে করতে ঢুকলেন নদিয়ার নেতা শঙ্কর সিংহ। হাতে দুটো প্রমাণ সাইজের ইলিশ। সে দিকেই চোখ গেল সোমেনের। একগাল হেসে শঙ্করের হাত থেকে মাছ নিয়ে সোজা অন্দরে। ইলিশ ভাপা, ইলিশ ভাজা আর ইলিশ সর্ষে রাঁধা হয়ে গেল। দুপুরে ভাত খেয়ে সোমেন সটান ঢুকে গেলেন নিজের ঘরে। দরজা বন্ধ।
এ দিকে উত্তর ২৪ পরগনার নেতারা বারবার ফোন করছেন। তাঁদের কোনও মতে সামলাচ্ছেন সোমেনের বন্ধু তথা সচিব বাদল ভট্টাচার্য। ভাতঘুম দিয়ে সোমেন যখন বেরিয়ে এলেন, সুয্যি ডুবুডুবু। সে দিন আর মিটিংয়ে যাওয়া হল না।
গল্পটা বলছিলেন একদা সোমেন-ঘনিষ্ঠ নেতা, বর্তমানে তৃণমূল বিধায়ক শঙ্কর সিংহই। পুব বাংলার যশোহরের ভূমিপুত্র সোমেন মিত্রের ইলিশ-প্রেমের কথা অবশ্য অনেকেরই জানা। কিন্তু ইলিশের টানে তিনি যেমন মিটিং শিকেয় তুলে রাখতে পারতেন, তেমন নিজেই গাড়ির স্টিয়ারিংয়ে বসে যে ছুটে বেড়াতেন রাজ্যের এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত, তা-ও মনে করিয়ে দিতে ভুলছেন না প্রৌঢ় বিধায়ক।
বৃহস্পতিবার সকালে সোমেন মিত্রের মৃত্যুর খবর পাওয়া ইস্তক ভেঙে পড়েছেন সত্তরের দশক থেকে তাঁর ছত্রচ্ছায়ায় বেড়ে ওঠা শঙ্কর। পুরনো দিনের নানা কথা মনে পড়ছে তাঁর। চাকদহের বাড়িতে বসে বলছেন, “মানুষটা ছিলেন অসম্ভব পরিশ্রমী। আমি তাঁর সঙ্গে বহু জায়গায় গিয়েছি। এক বার উত্তরবঙ্গ থেকে একই সঙ্গে ফিরছি। একটার পর একটা মিটিং। সোমেনদার গাড়িতেই ফিরছি। নিজেই ড্রাইভ করছেন। শেষে অনেক রাতে ক্লান্ত সোমেনদা আমাকে ড্রাইভারের সিট ছেড়ে দিলেন।”
এক বার রানাঘাটে আক্রান্ত হয়েছিলেন শঙ্কর। কলকাতার একটি বেসরকারি হাসপাতালে তাঁকে ভর্তি করা হয়। তাঁর মনে পড়ছে, ‘‘ডাক্তারদের সঙ্গে কথা বলে সোমেনদা নিজেই আমাকে সঙ্গে নিয়ে প্লেনে চলে গেলেন চেন্নাই। দাঁড়িয়ে থেকে আমার চিকিৎসা করালেন। আমার মতো অনেকেরই তিনি প্রকৃত অর্থে ‘ছোড়দা’ হয়ে উঠেছিলেন।”
রাজনীতির ঘূর্ণীপাকে ঘুরতে ঘুরতে অবশ্য পরে সেই সম্পর্ক অনেকটাই ফিকে হয়ে গিয়েছিল। সোমেন যখন তৃণমূলে, শঙ্কর তখনও কংগ্রেসে।
আবার শঙ্কর যখন তৃণমূলে এলেন, সোমেন কংগ্রেসে ফিরে গিয়ে আবার প্রদেশ সভাপতি। ২০১৮ সালে শঙ্কর তৃণমূলে যোগ দিচ্ছেন শুনে ফোন করেছিলেন তিনি। আর সেটাই ছিল শেষ কথোপকথন।
শেষ বার প্রদেশ সভাপতি হওয়ার পরে সোমেন এক দিন আচমকা ফোন করেছিলেন রাজনীতির ময়দান থেকে প্রায় হারিয়ে যেতে বসা কংগ্রেসের প্রাক্তন জেলা সভাপতি জ্যোর্তিময় ভট্টাচার্যকে। বলেছিলেন ফের জেলার দায়িত্ব নিতে। ক্যানসারে আক্রান্ত স্ত্রীকে ফেলে রাজনীতির ময়দানে ঝাঁপানোর ইচ্ছে জ্যোর্তিময়ের ছিল না। কিন্তু ফেলতে পারেননি ছোড়দার নির্দেশ। কংগ্রেসের বর্তমান নদিয়া জেলা সভাপতি জ্যোর্তিময় বলছেন, “সোমেনদা চলে গেলেন। কিন্তু রয়ে গেল তাঁকে ঘিরে হাজারটা স্মৃতি। কী পরম তৃপ্তি আমার স্ত্রীর হাতের রান্না খেতেন, ভুলব কী করে। আমার স্ত্রীকে বলতেন, ঘটির মেয়ে হয়ে এত ভাল রান্না করো কী ভাবে, সেটাই রহস্য!”
২০১৯ সালে যাঁকে পদ থেকে সরিয়ে জ্যোর্তিময়কে জেলা সভাপতি করেছিলেন সোমেন, সেই অসীম সাহারও মানুষটা সম্পর্কে দুর্বলতা এতটুকু কমেনি । কারণ সম্পর্কটা হয়ে দাঁড়িয়েছিল পারিবারিক। তাঁর বাড়ির দুর্গাপুজো হোক বা বাবা-মায়ের শ্রাদ্ধানুষ্ঠান, ছোড়দা হাজির। শেষের দিকে অসুস্থতার কারণে ইলিশের বদলে শিঙি মাছের ঝোল রান্না করে দিতে হত। অসীমের মনে পড়ে, “এক বার বলাগড়ে দলের মিটিং হচ্ছে। এক কর্মীর বাড়িতে খাওয়ার ব্যবস্থা করা হয়েছে। আমি বক্তৃতা করছি। আর পিছনে বসে সোমেনদা ক্রমাগত বলে চলেছেন, ‘অসীম, এবার থাম। দুপুরে ইলিশ আছে।’ শেষ পর্যন্ত আমাকে থেমে যেতেই হল!”
কংগ্রেসের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে নদিয়া বরাবরই সোমেন মিত্রের সঙ্গে থেকেছে। ১৯৯৮ সালে তৃণমূল তৈরি হওয়ার আগে কংগ্রেসের সাংগঠনিক নির্বাচনে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে হারিয়ে সোমেনকে প্রদেশ সভাপতি নির্বাচিত করার ক্ষেত্রে নদিয়া কংগ্রেস গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকাও নিয়েছিল। কংগ্রেসের দখলে থাকা পুরসভাগুলি নিয়ে কৃষ্ণনগরে আয়োজন করা হয়েছিল ‘নগরপালিকা সম্মেলন’। তার দায়িত্ব ছিল কৃষ্ণনগরের তৎকালীন কংগ্রেস পুরপ্রধান গৌরীশঙ্কর দত্তের উপরে। সেই গৌরীকেই পরে তৃণমূলের সঙ্গে যুক্ত থাকার অভিযোগে দল থেকে বহিষ্কার করেন সোমেন। কিন্তু ব্যক্তিগত সম্পর্ক বজায় রেখেছিলেন দু’জনেই। বিষণ্ণ গলায় গৌরীশঙ্কর বলেন, “রাজনীতির গণ্ডী ছাড়িয়ে ব্যক্তিজীবনেও আমাদের অভিভাবক হয়ে উঠতে পেরেছিলেন ছোড়দা। সেই অভিভাবক চলে গেলেন।”
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy