স্কুলে শিক্ষক এবং শিক্ষাকর্মী নিয়োগের ক্ষেত্রে স্কুল সার্ভিস কমিশনের (এসএসসি) বিরুদ্ধে মেয়াদ ফুরোনো প্যানেল থেকে কাউন্সেলিংয়ের অভিযোগ উঠেছিল। সুপ্রিম কোর্টে সেই অভিযোগের জবাব দিতে গিয়ে ২০১৮ সালের উত্তর দিনাজপুরের দাড়িভিট কাণ্ডকে কার্যত হাতিয়ার করেছে এসএসসি। সম্প্রতি তারা যে লিখিত বক্তব্য শীর্ষ আদালতে জমা দিয়েছে, তাতে বলা হয়েছে যে, প্রথম পর্যায়ের কাউন্সেলিংয়ে ২০১৮ সালে সেপ্টেম্বরে দাড়িভিট স্কুলে শিক্ষক নিয়োগ নিয়ে গোলমাল হয়েছিল। তার ফলে ফের শূন্যপদ খতিয়ে দেখে এবং সেই ভিত্তিতে প্যানেল থেকে কাউন্সেলিং শুরু করা হয়েছিল। তবে দাড়িভিটের পাশাপাশি কাউন্সেলিংয়ে বিলম্বের জন্য হাই কোর্টের একাধিক মামলার নির্দেশকেও ‘দায়ী’ করেছে এসএসসি। তবে শিক্ষাকর্মী নিয়োগের ক্ষেত্রে কোনও বিলম্ব হয়নি বলেও এসএসসি দাবি করেছে।
স্কুলে শিক্ষক এবং শিক্ষাকর্মী পদে প্রায় ২৬ হাজার প্রার্থীর নিয়োগ নিয়ে সুপ্রিম কোর্টে মামলা চলছে। এর আগে পুরো নিয়োগই বাতিলের নির্দেশ দিয়েছিল কলকাতা হাই কোর্ট। তার বিরুদ্ধে শীর্ষ আদালতে আর্জি জানিয়েছে এসএসসি এবং রাজ্য। সেই মামলায় বৈধ এবং অবৈধ ভাবে নিযুক্তদের চিহ্নিত করার ব্যাপারে এসএসসি-র দায়িত্ব নিয়েও প্রশ্ন উঠেছিল। লিখিত জবাবে সিবিআইয়ের দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে অবশেষে ৫৩০৩ জনের নিয়োগকে ‘অবৈধ’ হিসেবে চিহ্নিত করেছে এসএসসি। যদিও বঞ্চিত চাকরিপ্রার্থীদের অন্যতম আইনজীবী ফিরদৌস শামিম বলছেন, “এসএসসি-র দেওয়া এই তথ্যেও ফাঁক আছে।” পুরো নিয়োগ বাতিল হওয়ার পক্ষেই কোর্টে বারবার সওয়াল করেছেন তিনি।
মেয়াদ ফুরনো প্যানেল থেকে কী ভাবে নিয়োগ করা যায়, তা নিয়েও আদালতে বারবার সওয়াল করেছেন বঞ্চিত চাকরিপ্রার্থীদের আইনজীবী বিকাশরঞ্জন ভট্টাচার্য, সুদীপ্ত দাশগুপ্ত, বিক্রম বন্দ্যোপাধ্যায়েরা। সেই অভিযোগের জবাব দেওয়ার ক্ষেত্রে দাড়িভিট স্কুলের শিক্ষক নিয়োগ নিয়ে ‘হাঙ্গামার’ কথা তুলেছেন এসএসসি-র আইনজীবীরা। প্রসঙ্গত, ২০১৮ সালে উত্তর দিনাজপুরের দাড়িভিট স্কুলে বাংলার বদলে অন্য বিষয়ের শিক্ষককে পাঠানো নিয়ে গোলমাল হয়। গুলিবিদ্ধ হয়ে মৃত্যু হয় দুই তরুণের।
এসএসসি-র দাবি, সেই গোলমালের যাতে অন্য কোথাও পুনরাবৃত্তি না হয়, তাই শূন্যপদ ফের যাচাই করে দ্বিতীয় দফার কাউন্সেলিংয়ের কথা বলা হয় এবং এ ব্যাপারটি লিখিত ভাবে তৎকালীন শিক্ষামন্ত্রীকেও (পার্থ চট্টোপাধ্যায়) জানানো হয়েছিল। ‘প্রশাসনিক’ কারণেই এই পদ্ধতি করতে করতে ২০১৮ সালের সেপ্টেম্বর থেকে ২০১৯ সালের ফেব্রুয়ারি হয়ে গিয়েছিল। তার পরে লোকসভা ভোটের আদর্শ আচরণবিধির জন্য দেরি হয়েছিল বলেও এসএসসি জানিয়েছে। যদিও অনেকে মনে করিয়ে দিচ্ছেন, যে ঘটনা নিয়ে রাজ্য সরকারের এসএসসি নিয়োগের ক্ষেত্রে এত বিলম্বের সিদ্ধান্ত নিল, সেই ঘটনায় রাজ্যের সিআইডি পাঁচ বছরেও তদন্ত করেনি। ২০২৩ সালে এনআইএ তদন্তের নির্দেশ দেয় কলকাতা হাই কোর্ট। এ ছাড়াও, কলকাতা হাই কোর্টে একাধিক মামলার জন্য কাউন্সেলিং বারবার থমকেছিল, উল্লেখ করেছে এসএসসি।
শূন্যপদে নিয়োগের সুপারিশের থেকে কী ভাবে নিয়োগপত্র বেশি হল, তা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। এসএসসি-র জবাব, সুপারিশপত্র দিয়েছিল তারা এবং নিয়োগপত্র দিয়েছিল মধ্যশিক্ষা পর্ষদ। নিয়োগপত্র পেলেও অনেকে সেই শূন্যপদে যোগ দেননি। সেই সুপারিশপত্র বাতিল করে পরবর্তী চাকরিপ্রার্থীকে নতুন সুপারিশপত্র দিয়েছিল কমিশন। কিন্তু পর্ষদ তা করেনি। তাই গরমিল। যদিও আইনজীবী সুদীপ্ত দাশগুপ্তের বক্তব্য, “কমিশন যে যুক্তিতে আগের সুপারিশপত্র বাতিল করে নতুন সুপারিশপত্র দিল সেই একই যুক্তিতে পর্ষদেরও আগের নিয়োগপত্র বাতিল হয়ে নতুন নিয়োগপত্র দেওয়া উচিত ছিল। তা কেন হল না?
কেন আচমকা স্কুল পরিচালন কমিটির হাত থেকে নিয়োগপত্র দেওয়ার অধিকার সরিয়ে এনে পর্ষদের হাতে দেওয়া হয়েছিল, তা নিয়েও বহু প্রশ্ন আছে।” নিয়োগ প্রক্রিয়ায় বেসরকারি সংস্থা ‘নাইসা’-র বরাত পাওয়া নিয়েও নানা প্রশ্ন উঠেছে। যদিও এসএসসি দাবি করেছে, পরীক্ষা ব্যবস্থার গোপনীয়তা সুরক্ষিত রাখতেই ‘লিমিটেড টেন্ডারিং’ নিয়ম মেনে বরাত দেওয়া হয়েছিল।
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)