গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।
ইক্ষাকু বংশের রাজা দশরথের পুত্র রামচন্দ্র মহাকাব্যের পাতা থেকে অনেক দিনই রাজনীতির মঞ্চে। বাংলার ভোটমঞ্চেও এ বার ‘জয় শ্রীরাম’ ঘিরে জোর বিতর্ক। তবে রামের সঙ্গে দুর্গার পূর্বপুরুষ সংক্রান্ত তুলনা টেনে এ বার নতুন বিতর্কের অবতারণা করে ফেলেছেন রাম-রাজনীতির অন্যতম অগ্রণী, বিজেপি রাজ্য সভাপতি দিলীপ ঘোষ। প্রতিপক্ষ তৃণমূল এ নিয়ে আগেই সরব হয়েছে। এ বার বাংলার তিন পুরাণপণ্ডিতের সমালোচনার ত্রি-শূলেও বিদ্ধ দিলীপের নব-‘দুর্গাপুরাণ’।
রামের পূর্বপুরুষের নাম পাওয়া যায়, দুর্গার পাওয়া যায় কি? শুক্রবার এই প্রশ্ন তুলেই বিতর্কে জড়ান দিলীপ। একটি সর্বভারতীয় সংবাদমাধ্যম গোষ্ঠীর আলোচনাচক্রে তৃণমূলের সমালোচনা করতে গিয়ে দিলীপ বলেন, “খুব দুর্ভাগ্যের কথা। এমন একটা দল (তৃণমূল) যার কোনও মাথামুন্ডু নেই। কোনও আদর্শ নেই। ধর্মের জায়গায় রাজনীতির কথা বলে। রাজনীতির জায়গায় কথা বলে ধর্ম-জাতপাত নিয়ে। আমরা এমনটা করি না। আমরা খোলাখুলি রাজনীতি করি। ভগবান রাম এক জন রাজা ছিলেন। রামের পূর্বপুরুষের নাম পাওয়া যায়, দুর্গার পাওয়া যায় কি?” এই মন্তব্যের পরেই তৃণমূলের টুইটার হ্যান্ডলে দিলীপ ঘোষকে ট্যাগ করে লেখা হয়, “অভাবনীয়! বাংলার পবিত্র মাটিতে বসে দিলীপবাবু আমাদের দেবী দুর্গাকে অপমান করেছেন! দেবী দুর্গা আমাদের মা, আমাদের শক্তি, আমাদের অনুপ্রেরণা! যাঁরা নিজেদের হিন্দু ধর্মের রক্ষক ও সমর্থক বলে দাবি করেন, তাঁরাই এখন দেবী দুর্গার অবমাননা করছেন।”
তৃণমূল দিলীপের মন্তব্যে দুর্গার অপমান দেখছে। আর বাংলার তিন পুরাণবিদ দিলীপের তোলা প্রশ্নকে নস্যাৎ করছেন এক কথায়।
সত্যিই কি দুর্গার পিতৃপরিচয় পাওয়া যায় না? এই প্রশ্ন নিয়ে সংশ্লিষ্ট বিষয়ে চর্চা রয়েছে এমন তিনজনের সঙ্গে যোগাযোগ করে আনন্দবাজার ডিজিটাল। প্রথমজন বিশিষ্ট দুর্গাবিষয়ক গবেষক নবকুমার ভট্টাচার্য। দ্বিতীয় জন গবেষক ও প্রাবন্ধিক নৃসিংহপ্রসাদ ভাদুড়ি এবং তৃতীয় জন রামকৃষ্ণ মঠ ও মিশনের সহ-সাধারণ সম্পাদক তত্ত্ববিদানন্দ মহারাজ। তিন জনেই দিলীপের দাবিকে উড়িয়ে দিয়েছেন। সকলেরই বক্তব্য, দুর্গার আর এক পরিচয় তিনি হিমালয়-কন্যা। আবার দক্ষ-কন্যা সতীও দুর্গারই এক রূপ।
নবকুমার বলেন, “দিলীপবাবু কী বলেছেন জানি না তবে দুর্গার পিতৃপরিচয় নেই এমনটা মানা যাবে না। সেই উল্লেখ রয়েছে পুরাণেই। ঋগ্বেদের দেবীসূক্তে এমন উল্লেখ আছে যে তিনি আম্ভৃণ ঋষির বাক্রূপী কন্যা।” একই সঙ্গে নবকুমার একটি দুর্গাস্তোত্র উল্লেখ করে বলেন, দেবীপুরাণ অনুযায়ী দেবী হলেন ‘পর্বতরাজপুত্রিম্’। নবকুমার বলেন, “তবে এটাও ঠিক যে দুর্গার পিতৃপরিচয় নানা রকম পাওয়া যায়। তিনি যেমন হিমালয় কন্যা তেমনই দক্ষের কন্যা। তিনি যেমন মা মেনকার সন্তান তেমনই এটাও বলা হয় যে, দুর্গা অযোনিসম্ভবা। তিনি অনেক দেবতার শক্তি নিয়ে জন্ম নেন।”
নৃসিংহপ্রসাদ শুধু দিলীপের দাবি উড়িয়ে দেওয়াই নয়, একই সঙ্গে এমন প্রশ্নও তুলেছেন যে, রাজনীতির মধ্যে এ সব টেনে আনার দরকার কী! তিনি বলেন, “প্রত্যেক দেবতারই বংশ পরিচয় আছে। দুর্গা হিমালয় কন্যা। শিব তাঁকে বিয়ে করেছেন। কার্তিক, গণেশ তাঁর ছেলে। দুই মেয়ে লক্ষ্মী আর সরস্বতী।” একই সঙ্গে তাঁর অভিযোগ, “দেবতাকে যাঁরা পণ্য করেছেন তাঁরাই এই সব বলেন। এঁরা কিছুই জানেন না।” রামায়ণ, মহাভরত বিষয়ে গবেষক নৃসিংহপ্রসাদ আরও বলেন, “রামকে যাঁরা মানুষ হিসেবে দেখেন তাঁরা কী মনে করেন? রাম একজন রামা-শ্যামার মতো মানুষ ছিলেন?” বিজেপি রামচন্দ্রের পাশাপাশি ‘রামরাজ্য’ নিয়ে এত প্রচার করলেও নৃসিংহপ্রসাদ মনে করেন, প্রশাসক হিসেবেও রাম খুব একটা ভাল ছিলেন না। তিনি বলেন, “রামায়ণের উত্তরখণ্ডে যে বর্ণনা রয়েছে তাতে প্রশাসক হিসেবে রামের তেমন কোনও অবদানেরই উল্লেখ নেই। প্রজারঞ্জনের জন্য তিনি স্ত্রী ত্যাগ করেছেন। সেটা ভাল করেননি। তিনি সেটা ব্রাহ্মণ্যবাদের চাপে করেছেন।” স্ত্রীর চেয়ে রাষ্ট্রকে কি তিনি প্রাধান্য দেননি? এমন প্রশ্নের উত্তরে নৃসিংহপ্রসাদ বলেন, “রঘুবংশে সীতা বলছেন, আমিও তো রামের রাজ্যে একজন প্রজা। তিনি যদি প্রজারঞ্জন করেন তবে তো সীতার কথাও ভাবা উচিত ছিল।” তাঁর মতে, ভোটের বাজারে রাম বা দুর্গা কাউকেই টেনে আনা উচিত নয়। তিনি বলেন, “ওরা রামকে নিয়ে নেমেছেন বলেই এঁরা দুর্গাকে নিয়ে এসেছেন। কে কী কাজ করেছেন সেটা বলুন। নাগরিক ইস্যু নিয়ে রাজনীতি হোক।”
একই প্রশ্ন নিয়ে আমরা যোগাযোগ করি রামকৃষ্ণ মঠ ও মিশনের সাধারণ সম্পাদক সুবীরানন্দ মহারাজের কাছে। তিনি জানান, এই ব্যাপারে ভাল বলতে পারবেন তত্ত্ববিদানন্দ মহারাজ। পরে তত্ত্ববিদানন্দ বলেন, “দুর্গার বাবা হলেন হিমালয়। তিনি হিমালয় দুহিতা। মনে রাখতে হবে, যিনি পার্বতী, তিনিই দুর্গা। আগমনী গানে দুর্গা যে হিমালয় কন্যা তার ইঙ্গিত রয়েছে।” কিন্তু দিলীপের দাবি ছিল, রামচন্দ্র সত্যিই জন্ম নেওয়া ঐতিহাসিক চরিত্র আর মা দুর্গা ভক্তের কল্পনা। এই প্রসঙ্গে তত্ত্ববিদানন্দ বলেন, “রামকে মানুষ কল্পনা করলে দুর্গাকে কল্পনা করব না কেন। আর কল্পনা নয়, সবটাই বিশ্বাস। ঠাকুর রামকৃষ্ণ এতটাই বিশ্বাস করতেন যে আগমনী গান শুনে তিনি কাঁদতেন। ঠাকুরের মতো অনেকেই এটাকে বাস্তব সত্য মনে করতে পারেন। এটা ঠিক যে দুর্গা পৌরাণিক। একই সঙ্গে তিনি বিশ্বাসীর চোখে আন্তরিকও।”
এত কিছুর পরে দিলীপ ঘোষের দাবি, তিনি যা বলতে চেয়েছেন তার অপব্যাখ্যা করা হচ্ছে। একই সঙ্গে তাঁর দাবি, আদৌ তিনি দেবী দুর্গাকে অপমান করতে চাননি। দিলীপ বলেন, “স্বয়ং রামচন্দ্রই তো দেবী দুর্গার পূজা করেছেন। আমি দেবী আর ঐতিহাসিক চরিত্রের মধ্যে ফারাকটা বোঝাতে চেয়েছি। মা দুর্গাকে অপমান করার শিক্ষা বা সংস্কৃতি কোনওটাই আমার নেই। ভুল ব্যাখ্যা করে রাজনীতি করা হচ্ছে। কিন্তু তাতে কিছু কাজ হবে না। সাধারণ মানুষ ঠিকই বুঝতে পারছেন আমি কী বলতে চেয়েছি।”
দিলীপ যতই সাফাই দিন একটা বিষয় পরিষ্কার যে, বিধানসভা নির্বাচনের আগে অনেক বিতর্কের সঙ্গে আরও একটির সংযোজন হল। মহাকাব্যের কাহিনি অনুসারে রাবণকে বধের জন্য রাম যে দেবীর শরণ নিয়েছিলেন আজ যেন তাঁরই প্রতিপক্ষ হয়ে উঠেছেন তিনি। লড়াই যে দিকে যাচ্ছে তাতে নীলবাড়ির লড়াইয়ে ‘জয় শ্রীরাম’ আর ‘জয় মা দুর্গা’ হয়ে উঠতেই পারে যুযুধান স্লোগান। এই প্রসঙ্গে শনিবার সীতাকেও এনে ফেলেছেন তৃণমূল সাংসদ অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়। তাঁর কথা, “ওঁরা (বিজেপি) জয় সিয়ারাম না বলে শুধু জয় শ্রীরাম বলেন। কারণ সীতা নারী। নারীকে ওঁরা সম্মান দেন না। তাই দুর্গাকেও অপমান করেন।”
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy