Advertisement
E-Paper

‘ধাক্কা খেয়ে পড়ে যাই তেতলা থেকে’

যাদবপুরের ঘটনাটি শোনার পরে অস্থির হয়ে সন্দীপের মা পুষ্পমিতা তাঁকে ফোন করেছিলেন। আইআইটি-র ঘটনার খুঁটিনাটি ছেলের থেকেও মায়ের মনে বেশি দগদগে।

সন্দীপ সিংহ রায় (বাঁ দিকে) এবং রোশনী সেন (ডান দিকে)।

সন্দীপ সিংহ রায় (বাঁ দিকে) এবং রোশনী সেন (ডান দিকে)। —নিজস্ব চিত্র।

ঋজু বসু

শেষ আপডেট: ২০ অগস্ট ২০২৩ ০৯:২১
Share
Save

আইআইটি খড়্গপুরের আরকে হল-এর তেতলা থেকে তিনি যেখানে পড়েন, তার পাশেই সিমেন্টের চাতাল। তবে সন্দীপ সিংহরায় কপালজোরে ঘন পুরু ঘাসের জমিতে পড়েছিলেন। সেটাও অগস্ট মাসের রাত। বৃষ্টি হচ্ছিল বলে মাঠে কাদাও জমেছিল। না-হলে কী হতে পারত ভাবলে তিন দশক বাদেও শিউরে ওঠেন তিনি।

৩২ বছর আগে আইআইটি-তে র‌্যাগিংয়ের শিকার সন্দীপ এখন নিউ জার্সির প্রিন্সটনে প্রতিষ্ঠিত বিজ্ঞানী। দুই কন্যার বাবা। ফোনে বলছিলেন, “যাদবপুরের মেন হস্টেলের ছেলেটির মতো আমিও গ্রামের ছেলে। আমিও তেতলা থেকেই পড়েছিলাম। তবে র‌্যাগিং সহ্য করতে না-পেরে আইআইটি থেকে ছিটকে গেলেও আমি জীবনে ফেরার সুযোগ পেয়েছি।”

যাদবপুরের ঘটনাটি শোনার পরে অস্থির হয়ে সন্দীপের মা পুষ্পমিতা তাঁকে ফোন করেছিলেন। আইআইটি-র ঘটনার খুঁটিনাটি ছেলের থেকেও মায়ের মনে বেশি দগদগে। বর্ধমানের মেমারির বাড়ি থেকে সন্দীপের মা বললেন, “নিষ্ঠুরতা কতটা মাত্রাছাড়া হতে পারে, তা আমার ছেলের সময়ে বুঝেছি।” ধাক্কা খেয়ে সন্দীপ তেতলা থেকে নীচে পড়ার পরে র‌্যাগিংকারীরা অম্লান বদনে গা-ঢাকা দিয়েছিল। পরের দিন সকাল অবধি মাঠেই পড়ে
ছিলেন তিনি।

পুরুলিয়ার রামকৃষ্ণ মিশন বিদ্যাপীঠ থেকে মাধ্যমিকে দ্বিতীয় স্থানাধিকারী সন্দীপ নরেন্দ্রপুর রামকৃষ্ণ মিশনের কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিকেও মেধা-তালিকায় ছিলেন। মেমারির কাছে গ্রামের বাড়ি থেকে আইআইটি-তে গিয়েই সিনিয়রদের নিশানা হন তিনি। সন্দীপের মা বলেন, “ওর সারা গায়ে সিগারেটের ছ্যাঁকা দেওয়া হয়েছিল। মদের বোতলের ভাঙা কাচে পা ছিল ক্ষতবিক্ষত। একটি ভারী লোহার তালা দিয়ে নিজের মাথায় সজোরে বাড়ি মারতে বাধ্য করার পরে আমার ছেলেকে তেতলার কার্নিশে হাঁটতে বলা হয়। সব শেষে জল নিকাশি পাইপ বেয়ে ওকে ছাদে উঠতে বলা হল। সন্দীপ ভয় পাওয়ায় ওকে ধাক্কা মারে সিনিয়ররা।” পাইপের একাংশসুদ্ধই নীচে পড়ে যান সন্দীপ। হস্টেলে যাওয়ার দিন তিনেকেই এই অভিজ্ঞতা।

১৯৮৪ সালের উচ্চ মাধ্যমিকে প্রথম, বর্তমানে রাজ্যের আইএএস কর্তা রোশনী সেনও আইআইটি-জীবনে র‌্যাগিংয়ের চেহারাটা দেখেছেন। তিনি বলছেন, “প্রথম দশটা দিন আমরা কুঁকড়ে থাকতাম! সাংঘাতিক অপমানজনক কথা শুনতে হত। তবে মেয়েদের ক্ষেত্রে শারীরিক অত্যাচারটা ছিল না, এটাই বাঁচোয়া।” পরে সাইকেল চালাতে গিয়ে রোশনীর হাত ভাঙলেও র‌্যাগিং হয়েছে বলে রটে গিয়েছিল। আইবি-র গোয়েন্দারা তদন্তও করতে এসেছিলেন।

র‌্যাগিং নয়, তবে অসুস্থতার কারণে এক বছরের মধ্যে আইআইটি ছাড়েন রোশনী। প্রেসিডেন্সিতে পদার্থবিদ্যা নিয়ে ভর্তি হন। আর সন্দীপ স্ট্যাটিসটিক্স নিয়ে বিএসসি পড়তে নরেন্দ্রপুর কলেজেই ফিরে যান। পরে আইএসআই, আয়ওয়া স্টেট বিশ্ববিদ্যালয়ের পাট চুকিয়ে আমেরিকাতেই থিতু। বলছেন, “আইআইটি-র সেই অভিজ্ঞতা একবারই হয়েছে। এর পরে দেশে, বিদেশে কোথাওই এমন পীড়নতন্ত্রের মুখোমুখি হইনি।” পুষ্পমিতার অভিযোগ, “আমার ছেলেকে যারা মেরে ফেলতে চেয়েছিল, তার মধ্যে দিল্লির এক মন্ত্রীর পিএ-র পুত্র, বেনারস-কলকাতার অনেক কেউকেটাদের ছেলেরাও ছিল। ওদের বিরুদ্ধে মামলা করেও আমরা তুলে নিই। কারণ মামলায় সন্দীপকেই সাক্ষী দিতে হত। মনে হয়েছিল, তাতে ছেলেটার জীবনসঙ্কট হতে পারে।”

রোশনী বলছেন, “এটা দুঃখের যে র‌্যাগিং আজও বেড়েই চলেছে! যাদবপুরের প্রথম বর্ষের পড়ুয়াদের আলাদা রাখতে হবে। আর কোনও পথ নেই।” আর সন্দীপ বলছেন, “যাদবপুরের ছেলেটিকে আমরা হারিয়েছি। আশা করব, এই ঘটনায় দোষীরা অন্তত সাজা পাবে।”

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Harrasment kharagpur iit

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:

Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy

{-- Slick slider script --}}