গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।
লালগড়ের জঙ্গলখাস গ্রামের শবরপল্লি থেকে গোয়ালতোড়ের জঙ্গলে ঘেরা কাঞ্জিমাকলি ফুটবল মাঠের দূরত্ব কমপক্ষে ৩৫ কিলোমিটার। অন্য দিকে, ঝাড়খণ্ড সীমানা ঘেঁষা শিমুলপাল গ্রাম পঞ্চায়েত এলাকার দূরত্বও লালগড় থেকে প্রায় ৫৫ কিলোমিটার।
মঙ্গলবার বিকেলে যখন ঝাড়গ্রাম জেলা প্রশাসনের তাবড় কর্তারা জঙ্গলখাসের ৭ শবরের মৃত্যু নিয়ে ব্যতিব্যস্ত, তখন কাঞ্জিমাকলির ফুটবল মাঠ থেকে গ্রেফতার করা হয় কলকাতার বাসিন্দা চার জনকে। এঁদের মধ্যে দু’জন আবার ছাত্র। তবে চার জনের এক জনকে গোটা রাজ্যের গোয়েন্দারাই বেশ ভাল করেই চেনেন। আগরপাড়া উষুমপুরের বাসিন্দা বছর পঞ্চাশের সব্যসাচী গোস্বামীকে এ রাজ্যের মাওবাদী নেতৃত্বের প্রথম সারিতেই রাখেন তাঁরা। একইসঙ্গে গোয়েন্দারা স্বীকার করছেন, শিমুলপাল গ্রাম পঞ্চায়েতের প্রত্যন্ত গ্রামগুলিতে যাতায়াত বেড়েছে বনপার্টির।
জঙ্গলখাসের ঘটনার সঙ্গে কাঞ্জিমাকলির গ্রেফতারির দূর দূর পর্যন্ত কোনও যোগ নেই। কিন্তু তাতেই অশনিসঙ্কেত দেখছেন রাজ্য পুলিশের একাংশ। চাপা অস্বস্তি তৈরি হয়েছে লালগড়ে শাসক দলের নেতৃত্বের মধ্যেও।
গোয়ালতোড় থেকে মাওবাদী সন্দেহে ধৃত সব্যসাচী গোস্বামী, টিপু সুলতান, অর্কদীপ গোস্বামী, সঞ্জীব মজুমদার। ছবি: সংগৃহীত।
মঙ্গলবার মৃত শবর পরিবারের সঙ্গে দেখা করে আসেন জেলাশাসক আয়েষা রানি। সারা দিন ওই গ্রামেই কাটান প্রশাসনের অনেক কর্তাই। জেলাশাসক শবরদের মৃত্যুর পেছনে অনাহার বা পুষ্টির অভাবের অভিযোগ উড়িয়ে দিয়েছেন। বুধবার মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় আয়েশার দাবিকে মান্যতা দিয়ে নবান্নে দাঁড়িয়ে স্পষ্ট বললেন, “অনাহারে কেউ মারা যায়নি। চাল সবার কাছে পৌঁছেছে। পিছিয়ে পড়া এলাকার জন্য বিশেষ প্যাকেজও রয়েছে সরকারের।”
মুখ্যমন্ত্রী, শাসক দলের নেতারা সবাই অনাহার-অপুষ্টি উড়িয়ে দিলেও, মঙ্গলবার দফায় দফায় শবর পরিবারগুলোর জন্য বস্তা বস্তা চাল, বিস্কুটের প্যাকেট এসেছে। তার পরেও সরকারি উদ্যোগে সকাল বিকেল খাওয়ানো হয়েছে ডাল-ভাত। ‘‘খাবারের যদি অভাব না থাকে, তবে এত খাবার কেন?’’— প্রশ্নটা করেই ফেললেন জঙ্গলখাস গ্রামের পাশে করমশোল গ্রামের সাঁওতাল প্রৌঢ়া দুলকি হেমব্রম।
আরও পড়ুন: কেউ অনাহারে মারা যাননি, নবান্নে দাঁড়িয়ে বলে দিলেন মমতা
বিডিওকে গ্রামে পেয়ে অনেকেই এসেছিলেন তাঁদের অভাব অভিযোগ জানাতে। তাঁদের সঙ্গে দুলকিও ছিলেন। তাঁর বাড়ির সামনের কুয়োই এখন জলের জন্য গ্রামের বহু মানুষের একমাত্র ভরসা। রাস্তার পাশে অনেকগুলো সাবমার্সিবল পাম্প বসানো আছে। কিন্তু, অধিকাংশ জলের ট্যাঙ্কই ফাঁকা। তাই প্রায় দু’দশক আগে তৈরি ওই সরকারি কুয়োই জনগণের ভরসা। অনুন্নয়ন আরও আছে। যেমন, সরকারি প্রকল্পের শৌচালয়ের চারটে দেওয়াল খাড়া হলেও বাকি কাজ এগোয়নি। প্রকাশ্যেই অনেকে বলতে থাকেন, সরকারি বাড়ি পেতে গেলে পার্টি ফান্ডে টাকা দিতে হয়। অনুন্নয়ন নিয়ে গ্রাম থেকে উজিয়ে আসা আমজনতার অভিযোগ যত বাড়ছিল, ততই অস্বস্তি বাড়ছিল শাসক নেতাদের।
তারই মধ্যে ত্রাণের জন্য আসা সরকারি চালের অবস্থা দেখে তৃণমূল ব্লক সভাপতি শ্যামল মাহাতোকেই দরবার করতে হয় বিডিওর কাছে। যাতে ওই চাল বদলে দেওয়া হয়। এক সময়ে লালগড় আন্দোলনের পোস্টার বয় ছত্রধর মাহাতোর ছায়া সঙ্গী শ্যামল। তিনি ছাড়াও লালগড়ের অনেক তৃণমূল নেতাই সাক্ষী, কী ভাবে পুলিশি তল্লাশির নামে হামলায় ছোটপেলিয়ার ছিতামণি মূর্মূর চোখ নষ্ট হওয়ার খবর দাবানলের মতো ছড়িয়ে গিয়েছিল গোটা জঙ্গল মহলে।
আরও পড়ুন: রোজ নাম বদলাচ্ছে ওরা, বাংলা নিয়ে চুপ কেন, তোপ মমতার
ছিতামণির ঘটনা ছিল একটা স্ফুলিঙ্গ, যা বিস্ফোরণ ঘটিয়েছিল দীর্ঘ দিন ধরে জমতে থাকা অসন্তোষের। আবারও যে অসন্তোষের গ্রাফটা লাফিয়ে বাড়ছে, তার কিছুটা নমুনা দেখা গিয়েছিল পঞ্চায়েত নির্বাচনের ফলে। জঙ্গলখাস, পূর্ণাপাণির মতো জঙ্গলে ঘেরা গ্রামগুলো, যারা এক সময়ে আশ্রয় দিয়েছিল কিষানজিকে, সেখানকার মানুষের অসন্তোষ কিন্তু চোখ এড়ায়নি শ্যামলদের।
জঙ্গলখাস গ্রামে গত বুধবার মৃত সুধীর শবরের ছেলে ক্ষ্যাপা শবর। নিজস্ব চিত্র।
পাশাপাশি, প্রতি দিন একটু একটু করে মূল স্রোতের রাজনীতি থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়া আদিবাসী সংগঠনের বাড়তে থাকা জনপ্রিয়তাও চোখ এড়ায়নি গোয়েন্দাদের। মাওবাদী দমনের সঙ্গে যুক্ত থাকা এক পুলিশ আধিকারিক বলেন, “বাঁশপাহাড়ি থেকে শিমুলপাল গ্রাম পঞ্চায়েত এলাকাতে ওই আদিবাসী সংগঠনের নেতৃত্ব হিসেবে উঠে আসছেন এমন কিছু মানুষ, যাঁদের এক সময়ে এলাকার মানুষ জনগণের কমিটির নেতা বলে চিনত।” রাজ্য পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগের এক শীর্ষ আধিকারিক স্বীকার করেন, “গত কয়েক মাসে বেশ কয়েক বার সীমানা পেরিয়ে মাওবাদী নেত্রী জবা মাহাতো শিমুলপাল গ্রাম পঞ্চায়েতের কয়েকটি গ্রামে এসেছে। অর্থাৎ ফের কিছু মানুষ ওদের আশ্রয় দিচ্ছে।”
আরও পড়ুন: আদিবাসীদের অস্ত্র তুলে নেওয়ার ডাক, জঙ্গলমহলে ফের সক্রিয় হচ্ছে মাওবাদীরা
সম্প্রতি ঝাড়খণ্ড লাগোয়া গিদনির রাস্তায় গাছে গাছে মাওবাদী পোস্টার যে ভুয়ো নয় তা স্বীকার করছেন জেলা পুলিশের কর্তারাই। আর তার পরে কলকাতা থেকে সব্যসাচীর গোয়ালতোড়ের গ্রামে গ্রামে ঘুরে বেড়ানো— সবটাই এক সুতোয় বাঁধতে চাইছেন গোয়েন্দারা। সব্যসাচীর সঙ্গী দুই ছাত্র টিপু সুলতান এবং অর্কদীপ গোস্বামী দীর্ঘ দিন ধরে ইউনাইটেড স্টুডেন্ট ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট (ইউএসডিএফ)-এর সক্রিয় সদস্য। এই সংগঠনটি পুলিশের খাতায় মাওবাদীদের ছাত্র ফ্রন্ট হিসাবে পরিচিত। পুলিশের দাবি, তাঁদের কাছ থেকে পাওয়া গিয়েছে মাওবাদী লিফলেট। সেখানে বর্তমান সরকার কী ভাবে আদিবাসী মূলবাসী মানুষদের বঞ্চিত করেছে তার খতিয়ান দেওয়া হয়েছে। সঙ্গে ডাক দেওয়া হয়েছে হাতে অস্ত্র তুলে নেওয়ার।
আরও পড়ুন: মৃত্যুর হাহাকার নেই, জীবিত শবরপল্লির চিন্তা শুধু দু’মুঠো ভাত
জঙ্গলখাসের ঘটনা প্রসঙ্গ তুলেই এক পুলিশকর্তা বলেন, “অসন্তোষ এক বার তৈরি হয়ে গেলে, সব্যসাচীদের গ্রেফতার করে পরিস্থিতি সামলানো যাবে না। এখন থেকেই সতর্ক হতে হবে।”
আর সেই অসন্তোষ যে শুধু ঝকঝকে রাস্তা বা দু’টাকা কেজি চালের প্রকল্প দিয়ে পুরোপুরি ঢেকে ফেলা যাচ্ছে না, তা জঙ্গলখাস গ্রামে সরেজমিনে ঢুকে, তার দীর্ঘশ্বাস শুনতে শুনতে উড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছে না মোটেই।
(পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন জেলার খবর এবং বাংলার বিভিন্ন প্রান্ত থেকে বাংলায় খবর পেতে চোখ রাখুন আমাদের রাজ্য বিভাগে।)
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy