দীর্ঘতম সফর আরও একটু দীর্ঘায়িত হল। আরএসএস প্রধান মোহন ভাগবতের বঙ্গসফরের মেয়াদ বাড়ল। এ যাত্রায় রবিবারই পশ্চিমবঙ্গে ভাগবতের যাবতীয় কর্মসূচি শেষ হওয়ার কথা ছিল। সোমবার বিশ্রাম নিয়ে তাঁর ফিরে যাওয়ার কথা। কিন্তু সেই সূচি বদলে গেল। বিশ্রাম তো হচ্ছেই না, সোমবার বাংলা ছাড়ছেনও না সঙ্ঘ প্রধান।
৬ ফেব্রুয়ারি পশ্চিমবঙ্গে আসেন ভাগবত। ৭ ফেব্রুয়ারি থেকে শুরু হয় তাঁর সাংগঠনিক কর্মসূচি। ভাগবত কলকাতায় পা রাখার আগের দিন দক্ষিণবঙ্গ আরএসএসের সদর দফতর কেশব ভবনে সাংবাদিক সম্মেলন ডাকা হয়েছিল। সেখানে সঙ্ঘের তরফে জিষ্ণু বসু এবং বিপ্লব রায় জানিয়েছিলেন ভাগবতের সবিস্তার কর্মসূচি। সেই অনুযায়ী সোমবার ভাগবতের বাংলা ছাড়ার কথা। কিন্তু রবিবার পূর্ব বর্ধমানের তালিতে সঙ্ঘের ডাকা ‘একত্রীকরণ সমাবেশ’ শেষ হওয়ার পরে জানা গেল, বেড়ে গিয়েছে ভাগবতের বঙ্গসফরকাল। আরএসএস প্রধানের সফরসূচি এ ভাবে বদলে যাওয়া বা দীর্ঘায়িত হওয়া সঙ্ঘ পরিবারে বিরল ঘটনা।
কেশব ভবনে সাংবাদিক সম্মেলনের দিন বিপ্লব বার বার বলেছিলেন, “সরসঙ্ঘচালক বা সরকার্যবাহের মতো সর্বোচ্চ পদাধিকারীদের সফরসূচি বছরের শুরুতেই নির্ধারিত হয়ে যায়। সাংগঠনিক প্রয়োজনীয়তা অনুসারেই বছরের শুরুতে সূচি তৈরি হয়।’’ সাংবাদিক সম্মেলনে এ প্রশ্নও সে দিন উঠেছিল যে, বাংলাদেশের চলতি পরিস্থিতির কথা মাথায় রেখে সঙ্ঘপ্রধান পশ্চিমবঙ্গে এমন বেনজির দীর্ঘ সফরে আসছেন কি না! জবাবে জিষ্ণু বলেছিলেন, “হঠাৎ করে কোনও পরিস্থিতির উদ্ভবের কারণে কখনও সরসঙ্ঘচালকের সফরসূচি নির্ধারিত হয় না বা বদলায় না। বাংলাদেশের পরিস্থিতির সঙ্গে মোহনজির দীর্ঘ বঙ্গসফরের কোনও সম্পর্ক নেই।” কিন্তু সঙ্ঘ সূত্রেই রবিবার জানা গেল, সূচিতে পরিবর্তন হয়েছে।
সঙ্ঘপ্রধান প্রত্যেক সফরেই যে প্রকাশ্য সমাবেশ করেন, এমন নয়। তবে কোনও সফরে প্রকাশ্য কর্মসূচি থাকলে, তা সাধারণত একেবারে শেষ কর্মসূচি হিসেবেই রাখা হয়। প্রকাশ্য সভা বা একত্রীকরণ সমাবেশের পরে আর কোনও কর্মসূচি রাখা হয় না। তার পরে একটা দিন হাতে রাখা হয় বিশ্রাম তথা প্রস্থানের জন্য (সঙ্ঘের ভাষায় ট্রানজিট ডে)। এ যাত্রায় ১৩ ফেব্রুয়ারি এবং ১৭ ফেব্রুয়ারি ট্রানজিট হিসেবে নির্ধারিত ছিল। ১৩ ফেব্রুয়ারিতে সূচি মেনেই কাজ হয়েছে। কিন্তু ১৭ ফেব্রুয়ারির সূচি বদলে গেল। সোমবার ভাগবত বিশ্রাম তো নিচ্ছেনই না। বাংলা ছেড়ে যাচ্ছেনও না। বর্ধমান শহরে গত কয়েক দিন যেখানে ছিলেন, সোমবারও সেখানেই থাকছেন বলে জানা গিয়েছে। সোমবার বিকেল পর্যন্ত একাধিক কর্মসূচি যোগ হয়েছে। সে সব সেরে তিনি মঙ্গলবার সকালে বর্ধমান থেকে কলকাতা বিমানবন্দরের উদ্দেশে রওনা দেবেন বলে সঙ্ঘ সূত্রে জানা গিয়েছে।
আরও পড়ুন:
কী কারণে সরসঙ্ঘচালকের সূচিতে এই বদল, তা নিয়ে আরএসএসের কোনও পদাধিকারী মুখ খোলেননি। সফর যে এক দিন দীর্ঘায়িত হয়েছে, সে কথাও প্রথমে কেউ বলতে চাননি। পরে পূর্ব ভারতের সঙ্ঘচালক জয়ন্ত রায়চৌধুরী এবং আর এক সঙ্ঘনেতা সুশোভন মুখোপাধ্যায় এ খবরের সত্যতা স্বীকার করেন। কিন্তু সফর দীর্ঘায়িত হওয়ার কারণ সম্পর্কে তাঁরাও কোনও মন্তব্য করতে চাননি।
আরএসএস সূত্রের খবর, ‘মধ্যবঙ্গ’ সাংগঠনিক এলাকায় কার্যকলাপ দ্রুত বাড়াতে চাইছেন ভাগবত। আরএসএসের সাংগঠনিক কাঠামো অনুযায়ী বাংলা যে তিনটি প্রদেশে বিভক্ত, তার মধ্যে ‘মধ্যবঙ্গ’কে ‘দক্ষিণবঙ্গের’ চেয়ে বেশি সম্ভাবনাময় বলে ধরা হয় বলে সঙ্ঘ সূত্রের দাবি। কিন্তু সম্ভাবনাময় হওয়া সত্ত্বেও সেখানে সঙ্ঘ পরিবার সাম্প্রতিক কালে জমি হারিয়েছে। নির্বাচনী ফলাফলে অন্তত তার প্রতিফলন রয়েছে। উত্তরবঙ্গে ২০১৯-এর লোকসভা, ২০২১-এর বিধানসভা এবং ২০২৪-এর লোকসভা, তিন নির্বাচনেই তৃণমূলকে পিছনে ফেলেছে বিজেপি। তাই উত্তরবঙ্গ নিয়ে সঙ্ঘ নেতৃত্ব খুব চিন্তিত নন। কিন্তু ‘মধ্যবঙ্গে’ ছবি অন্য রকম। ২০১৯ সালে সেখানে তৃণমূলের সঙ্গে বিজেপি সেয়ানে সেয়ানে টক্কর নিলেও ২০২১ এবং ২০২৪-এ বিজেপিকে ওই এলাকায় ক্রমশ জমি হারাতে দেখা গিয়েছে। ২০১৯-এর ভোটে ওই এলাকা থেকে যে সব লোকসভা আসন বিজেপি জিতেছিল, ২০২৪-এ তার অনেকগুলিই হাতছাড়া হয়েছে। আসানসোল, বর্ধমান-দুর্গাপুর, বাঁকুড়া, হুগলির মতো জেতা আসন ধরে রাখা যায়নি। উল্টে আরামবাগের মতো ‘সম্ভাবনাময়’ আসনেও বিজেপির ফল আগের চেয়ে খারাপ হয়েছে। এই পরিস্থিতি কি ভাগবতকে আরও একদিন আটকে দিল? উর্বর জমির অনুর্বর হয়ে পড়া আটকাতেই কি ভাগবত তাঁর সফরসূচি দীর্ঘায়িত করলেন? এ সব প্রশ্নই ঘুরতে শুরু করেছে।
সরসঙ্ঘচালকের বৈঠকে বা কর্মসূচিতে বিজেপির নির্বাচনী ফলাফল নিয়ে কখনও আলোচনা হয় না বলে সঙ্ঘ সূত্রের দাবি। তাই ‘মধ্যবঙ্গে’ কটা আসন বিজেপির হাতছাড়া হয়েছে, কেন হয়েছে, তা নিয়ে আলোচনা করার জন্য ভাগবত সফরকাল বাড়িয়ে দেবেন, এমন ভাবার কোনও কারণ নেই বলে দাবি করেছেন সঙ্ঘের পদাধিকারীরা। কিন্তু নির্বাচন নিয়ে সরাসরি ভাবিত না হলেও, বিজেপির নির্বাচনী ফলাফলে সঙ্ঘ পরিবারের বিস্তার বা সংকোচনের ইঙ্গিত কিছুটা হলেও যে নিহিত থাকে, সে কথা কেউ অস্বীকার করছেন না। সেই ফলাফলকে গুরুত্ব না-দিয়েও ভাগবতরা পারবেন না। তাই ‘উর্বর’ হয়ে ওঠা জমিতে হঠাৎ ‘ফলন’ কম কেন, সে প্রশ্ন নিয়ে সঙ্ঘচালকের বৈঠকগুলিতে আলোচনা হয়েছে বলে সঙ্ঘ-ঘনিষ্ঠ বিশ্লেষকদের ধারণা। এই পরিস্থিতিই ওই এলাকার প্রতি ভাগবতকে আরও একটু যত্নশীল করে তুলল বলে সঙ্ঘ সূত্রের দাবি।
রবিবার ভাগবতের সমাবেশে রাজ্য বিজেপির সামনের সারির অনেক নেতা হাজির ছিলেন। রাজ্য সভাপতি তথা কেন্দ্রীয় মন্ত্রী সুকান্ত মজুমদার, প্রাক্তন রাজ্য সভাপতি দিলীপ ঘোষ, প্রাক্তন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী সুভাষ সরকার, সাংসদ তথা রাজ্য সহ-সভাপতি জগন্নাথ সরকার, সাংসদ তথা রাজ্য সাধারণ সম্পাদক জ্যোতির্ময় মাহাতো, বিধায়ক তথা আর এক সাধারণ সম্পাদক অগ্নিমিত্রা পাল, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক (সংগঠন) সতীশ ঢোন্ড তাঁদের অন্যতম। ছিলেন বেশ কয়েক জন বিধায়কও। সভা শেষে সুকান্তের সঙ্গে ভাগবতের বেশ কিছুক্ষণ আলাদা কথাবার্তা হয়। আরএসএস প্রধানের সঙ্গে দেখা করতে ঢুকেছিলেন জ্যোতির্ময়, অগ্নিমিত্রা, জগন্নাথও। তবে কী কথা হয়েছে, তা নিয়ে কেউই মুখ খোলেননি।