ভূতের বাসা সেখানেই, যেখানে মনের অন্ধকার। কিন্তু মনে আঁধার তো আর খামোখা ঘনায় না। তার পিছনেও থাকে কাহিনি।
ভূতের বাসা সেখানেই, যেখানে মনের অন্ধকার। কিন্তু মনে আঁধার তো আর খামোখা ঘনায় না। তার পিছনেও থাকে কাহিনি। সেই সব কাহিনিতে ছায়া ফেলে ‘অতৃপ্ত আত্মা’র দল। নিঝুম রাতে গাঁয়ের বাঁশবাগান থেকে শুরু করে লন্ডন শহরের আলো ঝলমলে প্রাসাদ পর্যন্ত তেনাদের গতিবিধি। সেই তালিকায় শামিল কলকাতাও। এই শহরের একাধিক ভুতুড়ে বাড়ির কথা বাতাসে ভাসে। তবে সব থেকে জব্বর ভৌতিক আড্ডাটি বোধ হয় কলকাতা হাই কোর্ট। গথিক স্থাপত্যের আলো-আঁধারির বারান্দাময় এই বাড়িতে ঘটে গিয়েছে কত না নাটক! এই প্রাসাদেই কেউ দণ্ডিত হয়েছে বড়সড় অপরাধে, কারও বা হয়েছে ফাঁসির সাজা। এমন এক জায়গায় যদি ভূত না থাকে, তবে থাকবে কোথায়? কলকাতা হাই কোর্টের আইনজীবী থেকে সাফাইকর্মী, অনেকের মুখেই শোনা যাবে ভূত নিয়ে বিচিত্র সব কাহিনি।
ভারতের সবচেয়ে পুরনো হাই কোর্ট কলকাতায়। বেলজিয়ামের ক্লোথ হলের কায়দায় বানানো এই ভবনটির স্থাপত্য অসাধারণ। ভবনটির এই স্থাপত্যগত বিরলতার জন্যই এটি ঐতিহ্যবাহী বাড়ি (হেরিটেজ বিল্ডিং)-র তকমাও পেয়েছে। এখানে বছরভর প্রচুর মানুষ আসেন বিচারের আশায়। সারা দিন অসংখ্য লোকের আনাগোনায় জমজমাট থাকে হাই কোর্ট পাড়া। কিন্তু সন্ধে নামলেই এই পাড়া যেন নিশুতপুরী। দিনের আলো ম্লান হতে শুরু করলে ধীরে ধীরে চার দিকে নেমে আসে নিস্তব্ধতা। আর রাতের বেলায় তো এই বাড়িতে প্রবেশ করার সময়ে তো পরিবেশ একেবারেই হলিউডি ‘হরর’ ছবির আঙ্গিকের। এই অদ্ভুত আবহ কলকাতার খুব কম জায়গাতেই রয়েছে। আর সেই জন্যই হয়তো কলকাতার ভুতুড়ে বাড়ির তালিকায় বেশ উপরের দিকেই রয়েছে হাই কোর্ট ভবন।
এই বাড়ির এখানে-ওখানে ছড়িয়ে রয়েছে গল্পের পর গল্প। তবে, ওই এলাকার ‘ভুতদর্শী’দের মতে, হাই কোর্টের ১১ নম্বর কোর্ট রুমের সামনে ঘুরে বেড়ায় অতৃপ্ত আত্মারা। কিন্তু ১১ নম্বর রুমটিই কেন বাছল ভূতেরা? এর পিছনেও রয়েছে ইতিহাস। ব্রিটিশ আমলে হাই কোর্ট চালু হওয়ার পর দ্বিতীয় তলের এই আদালত কক্ষেই বিচারপতির রায়ে ফাঁসির দড়িতে ঝুলেছেন বহু আসামি। তাঁদের মধ্যে যেমন অগ্নিযুগের বিপ্লবীরা রয়েছেন, তেমন অনেক কুখ্যাত দুষ্কৃতীর ফাঁসির আদেশও দেওয়া হয়েছে ওই কক্ষে। ফলে সেখানে ভূতের আখড়া না হওয়াই অস্বাভাবিক। অবশ্য ওই কক্ষটির অন্য বৈশিষ্ট্যও রয়েছে। কক্ষের ভিতরে ঢুকলে দেখা যাবে, ইংরেজ আমলের কাঠের আসবাবপত্র। সেগুলি সব কালো রং করা। শুধুমাত্র ওই কক্ষেই রয়েছে ১০টি দরজা। তার মধ্যে এখন ব্যবহার হয় মাত্র দু’টি। একটি দিয়ে বিচারপতিরা প্রবেশ করেন এবং অন্যটি আইনজীবী-সহ সাধারণের ব্যবহারের জন্য খোলা। এ ছাড়া ওই কক্ষের বেশির ভাগ অংশ জুড়ে রয়েছে একটি কালো রঙের বিশাল কাঠগড়া। যেখানে আসামিদের তোলা হত। তাৎপর্যপূর্ণ ব্যাপার, এই কাঠগড়ার মাঝখানে রয়েছে একটি সুড়ঙ্গ। শোনা যায়, কুখ্যাত দুষ্কৃতীদের মূল প্রবেশ পথ দিয়ে কোর্টে আনা হত না। নীচতলা থেকে সুড়ঙ্গের মধ্য দিয়ে তাদের সরাসরি আদালতে হাজির করানো হত। ওই আসামিদের মধ্যে অনেকের ফাঁসির আদেশও হয়েছে ওই কক্ষে। ভূতে অবিশ্বাসীরা মনে করেন, সেই কারণেই আজও অপবাদ শুনতে হয় এই কক্ষটিকে।
১১ নম্বর কোর্টে যে ভূত রয়েছে, এমন মনে করেন হাই কোর্টে কর্মরত অনেকেই। আবার সেখানে স্বচক্ষে ভূত দেখেছেন এমন দাবি করার মানুষও রয়েছেন কেউ কেউ। বেশ কয়েক বছর আগে ওই কক্ষের বাইরে নিরাপত্তার জন্য দিনরাত পুলিশ মোতায়েন থাকত। এক পুলিশকর্মীর দাবি, তিনি স্বয়ং ভূতের উপস্থিতি অনুভব করছেন। ওই পুলিশকর্মী জানান, এক বার ওই কোর্টের বাইরে রাতে ডিউটি করছিলেন তিনি। রাত অবশ্য তখন খুব বেশি হয়নি। ৮টা বা সাড়ে ৮টা হবে। তখন হঠাৎ করে তাঁর প্রচণ্ড জ্বর আসে। বসে থাকতে না পেরে সামনের বেঞ্চে বিশ্রাম নেওয়ার জন্য শুয়ে পড়েন তিনি। তার কিছু ক্ষণ পরেই মাথার দিক থেকে অস্বাভাবিক শব্দ শুনতে পান। তাঁর কথায়, ‘‘চোখ ঘুরিয়ে তাকাতেই হাড় হিম করা দৃশ্য দেখতে পাই। আমার মাথার সামনেই বসে রয়েছেন কয়েদির পোশাক পরা এক ব্যক্তি। জ্বরের ঘোরে দেখার ভুল হয়েছে কি না তা যাচাই করতে নিস্পলক ভাবে চেয়ে রয়েছি ওই অবয়বের দিকে। সঙ্গে সঙ্গে ঘোর কাটতেই বুঝতে পারি, আমার সামনে ভূত বসে। শুকনো ভয়ার্ত কণ্ঠে আওয়াজ বেরোচ্ছে না। কোনও মতে দৌড়ে নীচে নামি।’’ শোনা যায়, তার পর থেকে নাকি রাতেরবেলায় সেই কক্ষের বাইরে পুলিশ পাহারা উঠে গিয়েছে।
আদালত কক্ষের তালা খোলা এবং বন্ধ করার দায়িত্বে কাজ করেন এক কর্মী। তিনিও নাকি ১১ নম্বর কোর্টে ভূতের উপস্থিতি অনুভব করছেন। তাঁর কথায়, ‘‘আমার কাছে কয়েকশো চাবি রয়েছে। কোর্ট বন্ধের সময় একে একে সব রুমে গিয়ে তালা দিতে হয়। এক দিন অন্য রুমগুলিতে চাবি লাগাতে লাগাতে একটু দেরি হয়ে যায়। সন্ধে ৭টা নাগাদ ১১ নম্বর কোর্টে চাবি লাগাতে যাই। দরজার সামনে যেতেই ভিতর থেকে খুটখাট, খচখচ শব্দ শুনতে পাই। ভাবলাম, কোর্ট তো অনেক আগেই বন্ধ হয়ে গিয়েছে। তা হলে ভিতরে কে? ভয়ে ভয়ে দরজার এক দিকটা খুলে দেখি, কেউ নেই! অনেক পাখার মাঝখানে শুধু একটি পাখা চলছে। পাখাটি বন্ধ করে দরজা আটকাতে যাব, এমন সময় দেখি অন্য একটি পাখা ঘুরছে! তখন বুঝতে আমার অসুবিধা হয়নি, এ ভুতুড়ে কাণ্ড ছাড়া আর কিছু নয়!’’ সন্ধের পর সেখানে ভয়ের কথা শোনা যায় অনেক আইনজীবীর মুখেও। এক আইনজীবী বলেন, ‘‘এখানে ভূত দেখেছি, এ কথা বলব না। তবে রুমের সামনে দিয়ে গেলে গা ছমছম করে। কখনও কখনও মানুষের গলার মতো কর্কশ ডাক শুনতে পাই বলে মনে হয়। তবে তা অন্য কোনও প্রাণীরও হতে পারে!’’
মজার ব্যাপার, কলকাতা হাই কোর্টে শুধু যে আসামিদের ভূত রয়েছে এমন নয়। শোনা যায়, অনেক সাহেব আইনজীবী ও বিচারপতির ভূতও রয়েছে হাই কোর্টে। ১১ নম্বর কোর্টের ঠিক উল্টো দিকের বারান্দায় অর্থাৎ এখন যেটি ১ নম্বর কোর্ট চত্বর, সেখানে ঘোরাফেরা করে সাহেবদের ভূত। ওই বারান্দায় সার সার দিয়ে রয়েছে হাই কোর্টের প্রাক্তন বিশিষ্ট বিচারপতিদের মূর্তি। হাই কোর্টে চা দেন, এমন এক কর্মীর দাবি, রাতে বিচারপতির পোশাক পরা অনেক সাহেবকেই ঘুরে বেড়াতে দেখা যায় ওই বারান্দায়। অর্থাৎ বলাই যায়, বিচারপতি থেকে আসামি— সবার ভূত বেশ সহাবস্থানেই রয়েছে কলকাতা হাই কোর্টে!
ভূত আছে কি নেই, এ নিয়ে তর্ক বহমান থাকবেই। তবে, তেনারা থাকুন বা না থাকুন, দেখা দেন বা না দেন, গা ছম ছম থাকবে, হঠাৎ করে বওয়া দমকা হাওয়া দীর্ঘশ্বাসের অনুষঙ্গ বয়ে আনবে, কলকাতা হাই কোর্টের মতো আলো-আঁধারির প্রাসাদে সামান্য শব্দও মনে হবে— আছে, আছে। কোথাও কিছু আছেই।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy