রমজানের শেষ দিন উদয়নারায়ণপুরের ওসি তাঁকে ডেকে পাঠান। তাঁর হাতে তুলে দেওয়া হয় ২৫ হাজার টাকা।
লকডাউনের মধ্যে চলছে রমজান। ইফতারের ঠিক পরেই বাড়ির বাইরে চোখ যেতে রিনা সে দিন দেখেছিলেন, এক জন লোক এসে খেতে চাইছে। আনন্দবাজার ডিজিটালকে নিজের অভিজ্ঞতা বলতে গিয়ে রিনা খাতুন বলে উঠলেন, “মানুষটাকে লোকে পাগল বলে। কিন্তু দেখলাম ওর আর আমার পেটের জ্বালা এক! ঘরে যা ছিল দিলাম।” থার্ড ইয়ারে পড়া জসমিনা ওরফে রিনা খাতুন সোশ্যাল মিডিয়া থেকেই করোনায় অনাহারের ছবির আঁচ করতে পেরেছিলেন। “বুঝতে পারছিলাম। রোগ মানুষের ভাত কেড়ে নিচ্ছে। হাওড়ায় উদয়নারায়ণপুরের আশপাশে দেখতে পাচ্ছিলাম ছবিগুলো কেমন করে পাল্টে যাচ্ছে। রাজমিস্ত্রির ভরা সংসার, অথচ ঘরে ভাত নেই। ট্রলিওয়ালা রাস্তায় ঘুরছে চালের জন্য, আর আমাদের অঞ্চলের ভিক্ষাজীবী, সে-ও দেখছি লকডাউনে ভিক্ষা করতে পারছে না! মরছে খিদের জ্বালায়!” এক নিঃশ্বাসে কথাগুলো বলে যাচ্ছিলেন রিনা।
রাতে ঘুমোতে পারতেন না তিনি। ছটফটিয়ে উঠতেন, “বুঝতাম টাকা লাগবে। বন্ধুদের, এনজিও-কে বলেছিলাম। এনজিও কিছুটা সাহায্য করলেও খুব বেশি টানতে পারেনি ওরা। আর কেউ এগিয়ে আসেনি! এত মানুষ তাও কেউ এগিয়ে এল না?” এখনও বিস্ময় লেগে আছে রিনার গলায়। রুজি-রোজগারহীন মানুষের না খেতে পাওয়ার জ্বালা কিছুতেই মেনে নিতে পারছিলেন না তিনি। “আমি বরাবর পরিবারের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছি। বাবা বিয়ে দিতে চেয়েছিল। সাফ জানিয়েছিলাম, চাকরি না করে বিয়ে করব না। আমার বাড়ির লোক জানে কতটা জেদি আমি!” সেই জেদ রিনাকে এক লহমায় সকলের চেয়ে আলাদা করে দিল। বাবা-মা কাউকে না বলে নিজের ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট থেকে ২৪০০ টাকা তুলে নেন। “কন্যাশ্রী-র টাকা ছিল। ওই টাকা দিয়ে ৭০টা পরিবারের ডাল, ডিম, সয়াবিন, মশলা কিনে প্যাকেট করে বাড়িতে রাখতে শুরু করলাম”, বললেন রিনা। তিনি আগেই তাঁর চারপাশের গ্রাম থেকে খবর সংগ্রহ করে একটা তালিকা তৈরি করেছিলেন।
আর বাড়ির লোক?
“কেউ কিচ্ছু জানত না। বন্ধুদের টাকা দিয়ে রেখেছিলাম, ওরাই খাবার কিনে এনে দিত। মাকে বলতাম, বন্ধুরা কিনে দিচ্ছি, আমাদের বাড়ি থেকে দিচ্ছি দু’-এক জন করে। লকডাউন তো, বেশি লোক একসঙ্গে আসত না!” উত্তেজিত রিনা। বাড়ির দুই ছোট বোন অবশ্য রিনার সঙ্গে হাত লাগিয়েছেন এই কাজে। একসময় টাকা ফুরিয়ে এসেছে রিনার। তাঁর ভাঁড়ার শূন্য। “বুঝলাম, একা এই কাজ সম্ভব নয়। মানুষকে দু’ মুঠো চাল দিতে পারছি না। খেতে দিতে পারছি না। কী মানুষ আমি?” নিজেকেই প্রশ্ন করে ক্লান্ত হয়ে পড়ছিলেন রিনা। তবে রমজানের শেষ দিন উদয়নারায়ণপুরের ওসি তাঁকে ডেকে পাঠান। তাঁর হাতে তুলে দেওয়া হয় ২৫ হাজার টাকা। “পরমব্রত আমার কথা শুনে থানার ওসি-র হাতে টাকা দিয়েছেন! ভাবতেই পারিনি! উনি যা করলেন, আবার কিছু পরিবারকে খাবার দিতে পারব আমি!” হেসে উঠলেন রিনা। এমন সুখের ইদ তাঁর জীবনে তেমন আসেনি।
আরও পড়ুন- ক্ষতের চেহারাটা সামনে আসছে, হাসনাবাদ থেকে যোগেশগঞ্জের সোম-মঙ্গলবারের ছবি
“পরমব্রত আমার কথা শুনে থানার ওসি-র হাতে টাকা দিয়েছেন! ভাবতেই পারিনি! উনি যা করলেন, আবার কিছু পরিবারকে খাবার দিতে পারব আমি!”
অন্য দিকে পরমব্রত রিনা সম্পর্কে সোশ্যাল মিডিয়ায় লিখেছেন, “করোনা অতিমারি এবং তারপর সম্প্রতি সাইক্লোনের ফলে সর্বস্বান্ত হয়ে পড়া তার গ্রামের পরিবারকে সে নিজের বৃত্তির টাকা খরচ করে চালিয়েছে। আজ প্রিয়নাথ মান্না বস্তি কমিউনিটি কিচেন আর আমি সক্ষম হলাম একটি মস্ত হৃদয়কে এমন সাহায্য করতে।”
অবশেষে পরমব্রত চট্টোপাধ্যায়ের পোস্টে নিজের মেয়ের ছবি ও তাঁর কীর্তি সম্বন্ধে জেনেছেন রিনার বাবা। “বাবা এখন খুশি। আমার পাশে এগিয়ে এসেছে। ছবিটাও মোবাইলে রেখে দিয়েছে। মানুষকে সাহায্য করতে মাঝে মাঝে বিরোধী হতে হয়।” জোর গলায় বললেন রিনা। অতিমারি, অতি বিরল ঝড়ে নিঃস্ব হয়ে যাওয়া বাংলার আজ বড় প্রয়োজন এমন ‘বিরোধী’ মেয়েদের।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy