Advertisement
২২ নভেম্বর ২০২৪
R G Kar Protest

চেনা দাবি, অচেনা লড়াই! ভাবনার স্রোত মিলছে এক মোহনায়, লিখছে নাগরিক আন্দোলনের নয়া ইস্তাহার

সোমবার আরজি কর মামলার শুনানি রয়েছে সুপ্রিম কোর্টে। তার আগে রবিবার কলকাতা থেকে জেলায় জেলায় বিভিন্ন কর্মসূচি নেওয়া হয়েছে। সেই কর্মসূচির প্রচারে ছড়িয়ে পড়ছে পোস্টার, স্লোগান।

RG Kar Protest: Civil Society Creates New Manifesto of Mass Movement

আরজি কর-কাণ্ডের প্রতিবাদে নাগরিক আন্দোলন প্রতিদিন নতুন মোড় নিচ্ছে। —প্রতিনিধিত্বমূলক ছবি।

শোভন চক্রবর্তী
কলকাতা শেষ আপডেট: ০৮ সেপ্টেম্বর ২০২৪ ০৯:১২
Share: Save:

নয়ের দশকের গোড়ায় ‘আগুন দেখা’ এক কলমে-কণ্ঠে মিলেমিশে গিয়েছিল পোস্টারের রং আর চিৎকারের সুর। প্রায় নীরবে, নিভৃতে বসে তিনি এখন সাক্ষী হচ্ছেন এমন একটা নতুন সময়ের, যেখানে জানলার গরাদ ভেঙে হাজারে হাজারে মানুষ পথে। থরে থরে পোস্টার চিৎকার করছে সমাজমাধ্যমের জানলা খুললেই। লেখা থাকছে বিভিন্ন আঙ্গিকের কর্মসূচি। কোনও দল নেই, নেতা নেই। রয়েছে ভাবনার স্রোত। নানান স্রোতের মোহনায় জন্ম নিচ্ছে নতুন নতুন স্লোগান। স্লোগানই হয়ে উঠছে আন্দোলনের নয়া ইস্তাহার। এ ভাবেই, আরজি কর-কাণ্ডের প্রতিবাদে নাগরিক আন্দোলন প্রতিদিন নতুন নতুন মোড় নিচ্ছে, নতুন নতুন মাইলফলক তৈরি করছে।

বিক্ষিপ্ত ভাবে কয়েকটি ঘটনা বাদ দিলে, গত মাসখানেকের নাগরিক আন্দোলন বয়ে চলেছে গান, স্লোগান, ছবি, কবিতার আঙ্গিকে। স্লোগানে যেমন থাকছে আরজি করের নির্যাতিতার জন্য বিচারের দাবি, তেমনই থাকছে রাজনৈতিক স্পর্শও। ছড়িয়ে পড়া পোস্টারগুলিতে ডিজিটাল সৃজনশীলতাও নজর কাড়ার মতো। পেশাদার হাতের ছোঁয়া থাকছে পাড়ায় পাড়ায় বিভিন্ন কর্মসূচির পোস্টারে। কী ভাবে তৈরি হচ্ছে পোস্টার? কলকাতার একটি সুপরিচিত বিজ্ঞাপনী সংস্থার কর্মী অর্পণ দত্ত বললেন, ‘‘আমি ডিজিটাল ডিজ়াইনের কাজ করি। আমার বন্ধুরা, পরিচিতেরা তা জানেন। তাঁরা অনেকে আমায় অনুরোধ করেছেন। আমিও আন্দোলনকে সংহতি জানিয়ে পোস্টার বানিয়ে দিয়েছি।’’ তিনি এ-ও জানিয়েছেন, পেশাগত বন্ধুরাও একই ভাবে তাঁদের পরিচিতদের বৃত্তে পোস্টার বানিয়ে দিচ্ছেন।

৮ সেপ্টেম্বর মহামিছিলের ডাক।

৮ সেপ্টেম্বর মহামিছিলের ডাক।

স্বাধীন ভারতের সবচেয়ে স্বতঃস্ফূর্ত গণ আন্দোলন হিসাবে অনেকেই দেখছেন আরজি কর-কাণ্ডের প্রেক্ষিতে চলতে থাকা এই প্রতিবাদকে। অনেকে বলছেন, ১৯৫৯ সালের খাদ্য আন্দোলনকেও ছাপিয়ে গিয়েছে আরজি কর আন্দোলন। উল্লেখযোগ্য বিষয় হল, খাদ্য আন্দোলনের নেতৃত্ব পুরোপুরি ছিল রাজনৈতিক দলের হাতে। কিন্তু এই নাগরিক আন্দোলনের বিরাট অংশই দলহীন এবং ঝান্ডাহীন মানুষ। অতীতে কখনও মিছিলে-মিটিংয়ে যাননি এমন অনেককেও দেখা গিয়েছিল ১৪ অগস্টের মেয়েদের রাত দখলের কর্মসূচিতে। আন্দোলনের নতুন ধারা হিসাবে দেখা যাচ্ছে রাস্তা লিখনের সংস্কৃতি। বঙ্গ রাজনীতিতে দেওয়াল লিখনের সুদীর্ঘ ইতিহাস রয়েছে। কিন্তু এই আন্দোলনে দেওয়ালের বদলে ‘ক্যানভাস’ হচ্ছে রাস্তা। আঁকা হচ্ছে ছবি। যা বাংলাদেশের আন্দোলনে বার বার দেখা মিললেও, এই বাংলায় এত দিন ছিল ব্যতিক্রম।

আরজি কর-কাণ্ডের প্রতিবাদে রাস্তায় গ্রাফিত্তি।

আরজি কর-কাণ্ডের প্রতিবাদে রাস্তায় গ্রাফিত্তি। —ফাইল চিত্র।

সোমবার সুপ্রিম কোর্টে প্রধান বিচারপতি ধনঞ্জয় যশবন্ত চন্দ্রচূড়ের বেঞ্চে আরজি কর মামলার শুনানি রয়েছে। তার আগের দিন রবিবার কলকাতা থেকে জেলায় জেলায় বিভিন্ন কর্মসূচি নেওয়া হয়েছে। সেই কর্মসূচির প্রচারে ছড়িয়ে পড়ছে পোস্টার, স্লোগান। নকশা মোটামুটি এক রেখে সেই পোস্টারের জায়গা পরিবর্তন করে নিচ্ছেন সংশ্লিষ্ট এলাকার লোকজন। সমাজমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া পোস্টারগুলিতে অভিনব কর্মসূচির ঘোষণা করা হয়েছে। যেমন রবিবার রাতে গড়িয়া মোড় থেকে সুকান্ত সেতু পর্যন্ত পাঁচ জায়গায় রাস্তায় ছবি আঁকা হবে। সেই কর্মসূচির নাম দেওয়া হয়েছে ‘রাজপথই ক্যানভাস’। সেই কর্মসূচির স্লোগান, ‘মুছবি যত, আঁকব তত’। রবিবার বিকালে হেদুয়া থেকে কলেজ স্ট্রিট পর্যন্ত মিছিল করবেন রিকশা শ্রমিকেরা। তারও পোস্টার ছড়িয়ে পড়েছে সমাজমাধ্যমে। কুমোরটুলির মৃৎশিল্পীরা যে মিছিল ডেকেছেন, তার স্লোগান ‘কুমোরটুলি দিচ্ছে হাঁক, আমার দুর্গা বিচার পাক’। আবার রবিবার বিকালেই উত্তর কলকাতার বিভিন্ন স্কুল-কলেজের প্রাক্তনী, বিভিন্ন ক্লাবের সংগঠকেরা মিছিল করবেন স্বামী বিবেকান্দের বাড়ি থেকে শ্যামবাজার নেতাজি মূর্তি পর্যন্ত। সেই মিছিলের পোস্টারে শিরোনাম, ‘উত্তর উত্তর চায়’। রবিবার ওয়েস্ট বেঙ্গল জুনিয়র ডক্টরস ফ্রন্ট রাস্তায় নামছে। শীর্ষ আদালতে সোমবারের শুনানির আগে তাদের সেই কর্মসূচির যে পোস্টার সমাজমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে, তার স্লোগান ‘জনতার মতামত, রাজপথে আদালত’। রবিবার বিকেল পাঁচটা থেকে মিছিল টালিগঞ্জ থেকে হাজরা। ই-পোস্টারে লেখা হয়েছে ‘টলিপাড়া জানতে চায়, তিলোত্তমার খুনি কোথায়?’ সোমবার বিভিন্ন জায়গায় রাত ৮টা থেকে ১০টা পর্যন্ত গণঅবস্থানের কর্মসূচি নেওয়া হয়েছে। সেই কর্মসূচির নাম দেওয়া হয়েছে ‘নয় নয় নয়’। সেপ্টেম্বরের ৯ তারিখ রাত ৯টা থেকে ন’মিনিট নিঃশব্দ থাকার ডাক দেওয়া হয়েছে নাগরিকদের একাংশের পক্ষ থেকে। ছড়িয়ে দেওয়া ই-পোস্টারের স্লোগান ‘কোনও শব্দ নয়, স্তব্ধ থাক রাজ্য’।

এই পোস্টার সংস্কৃতিকে নতুন অভিমুখ বলে অভিহিত করেছেন যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলার অধ্যাপক জয়দীপ ঘোষ। তাঁর কথায়, ‘‘যে পোস্টারগুলি দেখতে পাচ্ছি, তার বেশির ভাগই গুণগত ভাবে অত্যন্ত উঁচু মানের। নাগরিক আন্দোলন এক অন্য রকম ধারায় বইছে। অনেকেই অন্তরালে থেকে এই সব সৃজনশীল কাজগুলি করছেন। আমার মনে হয়, রাজনৈতিক সংস্কৃতি নিয়ে ভবিষ্যতে যাঁরা গবেষণা করবেন, এই আন্দোলন, তার আঙ্গিক তাঁদের পর্যাপ্ত উপাদান জোগাবে।’’ আপাতত শত শত পোস্টারে সাধারণ দাবি একটাই—‘বিচার চাই’। সেই দাবিতেই কাতারে কাতারে মানুষ রাস্তায় নামছেন। ক্লান্তিহীন সেই সব জমায়েত প্রতিদিন নতুন নতুন নজির তৈরি করছে।

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy