মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। ফাইল চিত্র।
দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতায় পাশ হয়ে গেল রাজ্যে বিধান পরিষদ পুনরুজ্জীবনের প্রস্তাব। বিধানসভায় মঙ্গলবার ওই সংক্রান্ত আলোচনার সময়ে উপস্থিত ২৬৫ জন বিধায়কের মধ্যে ১৯৬ জন ভোট দিয়েছেন বিধান পরিষদের পক্ষে, বিপক্ষে ভোট পড়েছে ৬৯। বক্তা-তালিকায় নাম থাকলেও মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় অবশ্য এই আলোচনা এবং ভোটাভুটিতে উপস্থিত ছিলেন না। বিরোধী পক্ষ বিজেপির দাবি, বিধানসভায় তৃণমূলের সংখ্যাগরিষ্ঠতার সুবাদে বিধান পরিষদের প্রস্তাব পাশ হলেও লোকসভায় তার পথ মসৃণ হবে না। কারণ, বিজেপির অবস্থান বিধানসভার উচ্চ কক্ষ জিইয়ে তোলার বিরুদ্ধে এবং লোকসভায় বিজেপির নেতৃত্বাধীন এনডিএ-ই সংখ্যাগরিষ্ঠ।
রাজ্যে ৫২ বছর আগে অবলুপ্ত হয়ে যাওয়া বিধান পরিষদ ফের গঠনের জন্য এ দিন বিধানসভায় প্রস্তাব পেশ করেন পরিষদীয় মন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায়। সরকার পক্ষের যুক্তি, ভোটে নির্বাচিত হয়ে যাঁরা আইনসভার আঙিনায় প্রবেশ করেছেন, তাঁদের বাইরেও সমাজের বিভিন্ন অংশের ‘যোগ্য ব্যক্তি’দের প্রতিনিধিত্ব বাড়ানোর জন্যই বিধান পরিষদ ফিরিয়ে আনতে চাওয়া হচ্ছে। এর ফলে বিধানসভার পরিষদীয় কাজকর্মে জটিলতা ও দীর্ঘসূত্রিতা বাড়বে, অর্থসঙ্কটে ধুঁকতে থাকা রাজ্যের কোষাগারে বাড়তি খরচের বোঝা চাপবে এবং শাসক দলের ‘পছন্দের লোকজনকে পিছনের দরজা দিয়ে ঢোকানোর চেষ্টা হবে’— এই তিন যুক্তিতে বিধান পরিষদের প্রস্তাবের তীব্র বিরোধিতা করেছে বিজেপি। শাসক তৃণমূল আবার পাল্টা প্রশ্ন তুলেছে, বিধান পরিষদ নিয়ে এত সমস্যা থাকলে বিজেপি-শাসিত রাজ্যে ওই উচ্চ কক্ষ তুলে দেওয়া হয়নি কেন? খরচ নিয়ে মাথাব্যথা থাকলে প্রধানমন্ত্রী-সহ কেন্দ্রীয় সরকারের শীর্ষ ব্যক্তিদের বিলাসিতার ব্যয় নিয়েই বা ভাবা হচ্ছে না কেন? বিতর্কের শেষে ভোটাভুটিতে পাশ হয়ে গিয়েছে প্রস্তাব। পরিষদীয় মন্ত্রী পার্থবাবু রাজ্যের স্বার্থে বিরোধিতা ছেড়ে বিধান পরিষদ গঠনে বিরোধীদের কাছে সমর্থনের আবেদন জানিয়েছেন।
প্রস্তাবের পক্ষে বলতে গিয়ে বর্ষীয়ান মন্ত্রী সুব্রত মুখোপাধ্যায় এ দিন বলেন, আমেরিকা, ব্রিটেন-সহ পৃথিবীর বিভিন্ন প্রথম শ্রেণির দেশেই দ্বিকক্ষ আইনসভা রয়েছে। এই ব্যবস্থার প্রয়োজনীয়তা রয়েছে বলেই ওই সব দেশ দ্বিতীয় কক্ষ তুলে দেয়নি। অতীতে এ রাজ্যে যে বিদ্বজ্জনেরা বিধান পরিষদের সদস্য ছিলেন, তার বহু উদাহরণও দেন সুব্রতবাবু। তৃণমূলের বিধায়ক তাপস রায় সওয়াল করেন, রাজ্যে বিধান পরিষদ গঠনে বাধা দিতে হলে সংসদে রাজ্যসভাও তুলে দিতে হয়! প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী নিজের স্বাস্থ্য ঠিক রাখতে রোজ বিদেশ থেকে আনা দু’লক্ষ ৪০ হাজার টাকার মাশরুম খান বলে দাবি করে তাপসবাবুর প্রশ্ন, তখন কি খরচের কথা ভাবা হয় না? সাধারণ মানুষের সমস্যা নিয়ে চিন্তা থাকলে কেন্দ্র সেন্ট্রাল ভিস্টা প্রকল্পই বা করছে কেন? এ বারের বিধানসভায় বামেদের কোনও প্রতিনিধি না থাকলেও তৃণমূল সদস্যদের বক্তব্য একাধিক বার ঘুরে-ফিরে এসেছে সিপিএম তথা বামেদের প্রসঙ্গ।
সুব্রতবাবুর পাল্টা যুক্তি দিয়ে শিলিগুড়ির বিজেপি বিধায়ক শঙ্কর ঘোষ প্রশ্ন তোলেন, বিভিন্ন দেশের আইনসভায় দ্বি-কক্ষ থাকলেও প্রাদেশিক স্তরে তা কোথায় কোথায় আছে, তার উত্তর সরকারের কাছে আছে কি? এ দেশেই ২৩টি রাজ্যে বিধান পরিষদ নেই, আছে মাত্র ৬টি রাজ্যে। তৃণমূলের সরকার ক্ষমতায় আসার সময়ে ঋণের পরিমাণ ছিল দু’লক্ষ কোটি টাকা, এখন তা চার লক্ষ ৭৪ হাজার কোটি ছাড়িয়েছে। এই আর্থিক পরিস্থিতিতে নতুন কক্ষ কত দূর সঙ্গত? বিধান পরিষদ শুধু বামেদের মস্তিষ্কপ্রসূত হলে কংগ্রেসের সিদ্ধার্থশঙ্কর রায় তা সমর্থন করেছিলেন কেন, সেই প্রশ্নও তোলেন শঙ্করবাবু। বিজেপির মিহির গোস্বামী, আইএসএফের নওসাদউদ্দিন সিদ্দিকী প্রমুখও ‘সাদা হাতি’ পোষার বিরুদ্ধে জোরালো সওয়াল করেন। দলীয় বিধায়কদের যুক্তিকেই সমর্থন করে বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারী বলেন, ‘‘সংবিধানের ১৬৯ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, বিধানসভায় সংখ্যাগরিষ্ঠতা থাকলে কোনও প্রস্তাব পাশ হতেই পারে। সংখ্যার গরম আমরা দেখাতে চাই না। কিন্তু একই ভাবে লোকসভায় এনডিএ-র সংখ্যাগরিষ্ঠতা আছে। বিজেপির রাজনৈতিক অবস্থান রাজ্যে এক রকম, কেন্দ্রে অন্য রকম নয়।’’ বিধানসভায় পাশ করানোর আগে বিধান পরিষদের প্রস্তাব নিয়ে জনমত নেওয়ার কথাও বলেন বিরোধী দলনেতা।
আর্থিক সঙ্কটের বাস্তবতা মেনে নিয়েও জবাবি ভাষণে পরিষদীয় মন্ত্রী পার্থবাবু বলেন, ‘‘অভিনেতা, খেলোয়াড়, চিকিৎসক-সহ সমাজের বিভিন্ন স্তরের মানুষকে মুখ্যমন্ত্রী নির্বাচিত হয়ে আসার সুযোগ করে দিলেন। কিন্তু যাঁরা তার পরেও সুয়োগ পেলেন না, একটু দৃষ্টি প্রসারিত করে তাঁদের কথা ভাবলে ক্ষতি কী? প্রান্তিক চাষি, শ্রমিকেরা এখানে আসতে পারেন। টাকার অভাব আছে বলে উন্নয়ন হবে না? মানুষের পাশে দাঁড়াব না?’’ বিধানসভায় থাকার সময়ে তাঁদের যা অবস্থান ছিল, তা-ই বজায় রেখে সিপিএমের রাজ্য সম্পাদক সূর্যকান্ত মিশ্র এ দিন বাইরে বিবৃতি দিয়ে বলেছেন, ‘‘রাজ্যবাসীর স্বার্থ এবং রাজ্যের বর্তমান আর্থ-সামাজিক প্রয়োজনীয়তাকে বিবেচনা না করে সরকার পক্ষ সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে এই প্রস্তাব পাশ করিয়েছে।’’ অতিমারির বিপদ, বিপর্যস্ত শিক্ষাব্যবস্থা এবং মানুষের রুটি-রুজির বিপন্নতার সময়ে বিধান পরিষদ গঠন একেবারেই অপ্রয়োজনীয় বলে সূর্যবাবুর দাবি।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy