দুর্গাপুর এক্সপ্রেসওয়ের ধারে তাঁর কাটআউটে যেন জীবন্ত ছোঁয়া। প্রেক্ষাগৃহের চত্বরে ফাইবার গ্লাসের মূর্তিতে তিনি। সঙ্গে দলের প্রাক্তন সাধারণ সম্পাদক সীতারাম ইয়েচুরিও। বাম রাজনীতিতে এই সে দিনও যাঁরা দিকপাল ছিলেন, পাশাপাশি এখন তাঁরা ‘মূর্তিমান’! আর বাইরে রাস্তায় নজর করলে আরও অবিশ্বাস্য দৃশ্য!
সিপিএমের রাজ্য সম্মেলনে এ বারই প্রথম শোকপ্রস্তাবে নাম উঠে গেল ইয়েচুরি এবং বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের। যে হুগলি জেলার মাটিতে একটা ছোট গাড়ির কারখানা করতে গিয়ে বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের রাজনৈতিক ইনিংস বড় ধাক্কার মুখে পড়েছিল, সেই জেলাতেই সিপিএমের প্রথম রাজ্য সম্মেলনের আঙিনার বাইরে অপেক্ষমাণ একের পর এক অ্যাম্বাসাডর! যা ছিল প্রয়াত প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রীর প্রিয় বাহন! রাজনৈতিক মেরুকরণের আবহ পোক্ত করা তো বটেই, বঙ্গ রাজনীতিতে অর্থ ব্যয়েও বহু যোজন এগিয়ে গিয়েছে তৃণমূল কংগ্রেস এবং বিজেপি। তাদের যে কোনও আসরে নানা মাপের নেতাদের নানা দামের এসইউভি চড়ে আসতে দেখতে অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছেন বঙ্গবাসী। প্রাক্তন এক শাসক দলের আস্তাবলে এখনও গুচ্ছ গুচ্ছ অ্যাম্বাসাডর!
হুগলি জেলারই হিন্দমোটরে ছিল সাবেক এই গাড়ির কারখানা। উৎপাদন বন্ধ হয়ে সে কারখানার ঝাঁপ বন্ধ হয়ে গিয়েছে বহু দিন। আধুনিক বাংলায় সিপিএমের ভোট-বাক্সের ঝাঁপও ওঠার লক্ষণ নেই। যুগ যে দিতে যায় যাক, সিপিএমের নানা জেলার প্রতিনিধিদের সম্মেলনে নামিয়ে দিয়ে বাইরে প্রতীক্ষায় রয়েছে পুরনো সব সাদা অ্যাম্বাসাডর। কোনওটা সরাসরি দলের খাতায়, কোনওটা দলীয় মুখপত্রের নামে নথিভুক্ত। চাবি ঘোরাতে ঘোরাতে এক চালক বলছিলেন, ‘‘মডেল আর বেরোয় না, যন্ত্রাংশ পাওয়াও একটু সমস্যা। তবে কী জানেন, এ গাড়ির তুলনা হয় না!’’ সম্মেলন চত্বরে এসইউভি-র পাশাপাশি তাই তারাও স্বমহিমায়।
তাঁর ‘বুদ্ধদা’র প্রিয় গাড়ির এমন উপস্থিতি দেখলে নিশ্চয়ই স্মৃতিকাতর হতেন প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রীর আস্থাভাজন চালক মহম্মদ ওসমান। কী বলছেন তিনি? শরীরটা এখন খুব জুতে নেই। ফোনে ধরা গেল যখন, ওষুধ খেয়ে তিনি বিশ্রামে। তবে ‘বুদ্ধদা’র মূর্তি রয়েছে জেনে ডানকুনি কোল কমপ্লেক্সে সিপিএমের রাজ্য সম্মেলনের চত্বরে ঘুরে যাওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করছেন ওসমানের পুত্র।
আলিমু্দ্দিন স্ট্রিটে সিপিএমের রাজ্য দফতরে এখন আর অ্যাম্বাসাডরের দর্শন মেলে না বিশেষ। পুরনো গাড়ি বদলে নেতাদের জন্য পোক্ত এসইউভি-ই নিয়েছে দল। জেলায় জেলায় এখনও রয়ে গিয়েছে এক কালের আভিজাত্য এবং সরকারি ব্যবস্থার প্রতীক বেশ কিছু প্রতীক। সিপিএমের রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলীর এক সদস্য বলছেন, ‘‘এই ব্যাপারে অন্তত দলের কোনও নির্দেশিকা নেই। জেলাগুলো তাদের সুবিধা ও সংস্থান অনুযায়ী গাড়ি ব্যবহার করে। তবে পুরনো গাড়ি বেশি দিন রেখে দিলে রক্ষণাবেক্ষণটা সমস্যা হয়ে যায়।’’
ডানকুনিতে শনিবার প্রবীণ নেতা বিমান বসুর হাতে দলের পতাকা উত্তোলন করে আনুষ্ঠানিক সূচনা হয়েছে সিপিএমের ২৭তম রাজ্য সম্মেলনের। ভিতরে উদ্বোধনী ভাষণে দলের পলিটব্যুরো কো-অর্ডিনেটর প্রকাশ কারাট বলেছেন, ‘পশ্চিমবঙ্গে মানুষকে সমবেত করার ক্ষেত্রে দল ভাল কাজ করছে। তবে গ্রামে আমাদের নজর দিতে হবে। গ্রামীণ গরিব মানুষের মধ্যে দলের সক্রিয়তা বাড়াতে হবে। শ্রেণি আন্দোলনের তীব্রতা বাড়লে দলের জনভিত্তিও বাড়বে’। তারই পাশাপাশি তাঁর পুরনো ‘আধিপত্যবাদী’ তকমার বদলে বিজেপির শাসনকে ‘নব্য ফ্যাসিবাদী’ বলে আক্রমণ করেছেন কারাট। ইয়েচুরি-হীন সম্মেলনে কারাট শরিক হয়ে গিয়েছেন প্রয়াত সতীর্থের করে যাওয়া বিশ্লেষণে!
একই সঙ্গে কারাটের গলায় আক্ষেপ শোনা গিয়েছে, তরুণ প্রজন্ম আন্দোলনে অংশগ্রহণ করলেও সংগঠনে তাদের সে ভাবে নিয়ে আসা যাচ্ছে না। তরুণদের বেশি করে জায়গা দিতে দলে বয়স-নীতি আগেই প্রবর্তন করে ফেলেছে সিপিএম। কিন্তু গাড়ির বেলায় সেই ‘বুড়ো অ্যাম্বাসাডরে’র অবসর নেই! পূর্ব বর্ধমানের এক প্রতিনিধি সহাস্য বলছেন, ‘‘পুরনো চাল ভাতে বাড়ে!’’ হেসেই সম্মতিসূচক ঘাড় নাড়ছেন কেন্দ্রীয় কমিটির এক নেত্রী।
এসইউভি-শোভিত, দাপটের রাজনীতির ময়দানে অ্যাম্বাসাডর চেপে আরাম পাচ্ছে বুদ্ধদেবের দল!
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)