Advertisement
২২ নভেম্বর ২০২৪
গ্রাম দর্শন
Muslim

‘নেতাদের মতো কি ঝগড়া করলি চলে?’

ভাতের হাঁড়িতে রাজনীতি থাকে। ঘ্রাণও থাকে। কিন্তু রাজনীতির আরশিতে কতটুকুই বা ধরা পড়ে সেই ঘ্রাণ, জীবনের আস্বাদ

স্বপ্ন: লালগোলায় রহমতুল্লাহ্‌ হাই মাদ্রাসায় ছাত্রীরা।

স্বপ্ন: লালগোলায় রহমতুল্লাহ্‌ হাই মাদ্রাসায় ছাত্রীরা। নিজস্ব চিত্র।

গৌতম চক্রবর্তী
লালগোলা শেষ আপডেট: ১৮ ফেব্রুয়ারি ২০২১ ০৬:১৭
Share: Save:

লালগোলা স্টেশন ছেড়ে রেললাইন ধরে সোজা এগিয়ে গেলে কাঠের বাফার। সেই বাফার পেরিয়ে পরিত্যক্ত লাইনে পাকা ঘর বেঁধে রয়েছেন প্রায় দেড়শো জন বাসিন্দা।

ঘরে ইলেকট্রিক আলো আছে। রাস্তার ধারে টাইমকলে জল। শেষ দুপুরে বালতি ভরে ফিরছিলেন শোভা শীল আর রহিমা বিবি। বাড়ির লোকে আপত্তি করে না মুসলমানের সঙ্গে জল আনতে? উত্তরে হেসে একে অন্যের গায়ে ঢলে পড়লেন দুই সখী, ‘‘না গো, আমাদের এখানে উসব নাই। আমরা গরিব মানুষ, সবাই সবার বাড়িতে যাই। নেতাদের মতো ঝগড়া করলি চলে?’’

এই পরিত্যক্ত লাইনের আশপাশে বসতি বাঁধতে বাঁধতেই গড়ে উঠেছে গাবতলি গ্রাম। সেখানকার প্রাথমিক স্কুলে ভোটের বুথ হয়। গ্রামের রাস্তা ধরে একটু এগোলে সীমান্তরক্ষী বাহিনীর শিবির। কাঁটাতারের পাশে এ দেশের ভুট্টাখেত। এলাকার বাসিন্দা, লেখক নীহারুল ইসলামকে জিজ্ঞাসা করলাম, এগুলি চুক্তি চাষ কি না! নীহারুল নিজেও চাষিবাড়ির ছেলে, জমি জায়গা আছে। তিনি বললেন, ‘‘একেবারেই না। আগে নিজেরাই গম লাগাত, কিন্তু গমে ২৮ দিন পরে জল দিতে হয়, অনেক হ্যাপা। ভুট্টায় অত যত্ন নিতে হয় না, গাছ এমনিতেই বাড়ে। লাভটাও বেশি।’’

সেই ভুট্টাখেতে আকীর্ণ দৃষ্টিপথ। আগে এ সব ছিল না, সরাসরি পদ্মার চর দেখা যেত। বাঙালির স্মৃতিতে জায়গাটা বিখ্যাত। ঋত্বিক ঘটকের কোমল গান্ধার ছবিতে এই পরিত্যক্ত বাফারের লাইনেই ‘দোহাই আলি দোহাই আলি’ গর্জনে শব্দেরা ছুটে আসে, বিজন ভট্টাচার্য আঙুল তুলে দেখান, ‘‘হুই, হুই পারে আমার দেশ।’’ ভোট আসে, ভোট যায়, কিন্তু বাফার অটল থেকে যায়।

ভারতীয় সীমান্তের পদ্মা নদীতেও এখানকার কুবের, রাসুরা মাছ ধরতে যান। ১৯৪৯ সালে তৈরি লালগোলা পদ্মা মৎস্যজীবী সমবায় সমিতির নিজস্ব দোতলা বাড়ি `পদ্মা ভবন`। স্থানীয় বাসিন্দা সুকুমার সাহা জানালেন, সমিতিতে এখন ১২০০-র বেশি সদস্য। সকালে সীমান্তরক্ষী বাহিনীর কাছে ভোটার কার্ড জমা রেখে ধীবরেরা নৌকো নিয়ে ভেসে পড়েন। সন্ধ্যায় মাছ নিয়ে এসে কার্ড ফেরত নেন। রাতের দিকেই জালে বেশি মাছ ওঠে। ফলে এ ভাবে কার্ড জমা দিয়ে রাতেও নদীতে নামার জন্য তাঁরা বিভিন্ন স্তরে আবেদন, নিবেদন করছেন। এখনও সিদ্ধান্ত হয়নি।

পদ্মার দিকের গ্রামগুলিতে জায়গায় জায়গায় কাঁটাতার আর ভারী লোহার দরজা। দরজার ও পারেও ভারতীয় খেত। সকাল ৬টায় একই ভাবে পরিচয়পত্র জমা রেখে চাষিরা খেতে কাজ করতে যান, সন্ধ্যায় ফিরে আসা। লালগোলা পঞ্চায়েত সমিতির সভাপতি জাহাঙ্গীর মিঁয়া আঙুল তুলে দেখালেন, ‘‘খেতের ও পারে যে গ্রামটা দেখছেন, সেটা কিন্তু বাংলাদেশে।’’

এই লালগোলা সীমান্ত একদা ফেন্সিডিল, বেনাড্রিল ইত্যাদি ওষুধ পাচারের জন্য বিখ্যাত ছিল। এখন তার চেয়েও বেশি আমদানি গরু পাচারে। ঝক্কি নেই, রাখাল গরুগুলিকে পদ্মার দিকে নিয়ে যাবে। ও পারে লোক আছে, গরু নিজে ভাসতে ভাসতে সেখানে উঠবে। একটা গরু পার করে দিলে ৫০০ টাকা। আর গরু তো একটা পার হয় না, জোড়ায় জোড়ায় এক-দেড়শো নামিয়ে দেওয়া হয়। শুনলাম, ও পারে ছোটখাটো বেঙ্গল ব্রি়ডের গরুর দাম সবচেয়ে কম। বাংলা গরু বড়জোর ৫০ হাজার টাকা, হরিয়ানা ব্রিডে ৭০ থেকে ৮০ হাজার। সেগুলি গাড়িতে সযত্নে আসে। হরিয়ানা, উত্তরপ্রদেশ থেকে কারা গরু পাঠায়? আমার সংবাদসূত্র এ বার নীরব হলেন, ‘‘আমি কী ভাবে বলব? আপনি তো সাংবাদিক, খবর নিয়ে দেখুন।’’ বুঝলাম, গোমাতারা সকলেই প্রভাবশালী। তাঁদের মাধ্যমেই কোটি কোটি টাকা হাতবদলের সমান্তরাল অর্থনীতি।

তিন লক্ষ ৮০ হাজার বাসিন্দার এই লালগোলা জনপদ এখনও মিউনিসিপ্যালিটি হয়নি, রয়েছে ১২টা গ্রাম পঞ্চায়েত। ৬৮ শতাংশ মুসলমান, এবং বাসিন্দারা সগর্বে বলেন, এখানে কখনও সাম্প্রদায়িক সংঘর্ষ হয়নি। সংখ্যাগুরুর দায় বুঝলাম শহরের পার্শ্বনাথ জৈন মন্দিরে সুনীল জৈনের সঙ্গে কথা বলতে বলতে। সুনীলরা চার পুরুষ এখানকার বাসিন্দা, মন্দির তাঁদের পরিবারের তৈরি। জিজ্ঞাসা করলাম, আপনি নিরামিষ খান, আর আপনার প্রতিবেশিরা গোমাংস খান। অসুবিধা হয় না? পরিষ্কার জবাব, ‘‘ওঁরা ওঁদের মতো খান, আমরা আমাদের মতো। অসুবিধার তো কিছু নেই। হ্যাঁ, এখানে ওঁরা সংখ্যাগুরু। তাই সংযত থাকাটা ওঁদের দায়িত্ব।’’

যাওয়া গেল শতাধিক বছরের পুরনো রহমতুল্লাহ্‌ হাই মাদ্রাসায়। করোনার পর সদ্য খুলেছে, নবম-দশমের মেয়েরা সাইকেল চালিয়ে আসছে। লস্করপুর উচ্চ বিদ্যালয়েও একই ছবি। উঁচু ক্লাসে মেয়েরাই বেশি। প্রধান শিক্ষক মহম্মদ জাহাঙ্গির আলম জানালেন, ড্রপ আউট ছেলেদের মধ্যে বেশি। তারা ক্লাস সেভেন, এইটের পরই স্কুল ছেড়ে দিনমজুরি খাটতে, বিড়ি বাঁধতে ছাত্র অন্যত্র পাড়ি দেয়। কন্যাশ্রীর কারণে মেয়েদের বাড়ি থেকে আর স্কুল ছাড়ার জন্য চাপ দেওযা হয় না। সমস্যা অন্যত্র। ছাত্র-শিক্ষক অনুপাত কোথাও যথাযথ নয়। লস্করপুর হাই স্কুলে ৩৭৪২ জন ছাত্রছাত্রীর জন্য ৪৩ জন শিক্ষক।

সংবিধান, ভোটযন্ত্র তৈরির ঢের আগে থেকে মুসলিমপ্রধান এই অঞ্চলের গ্রামগুলির নাম চমকে দেওয়ার মতো। কৃষ্ণপুর, রামচন্দ্রপুর, রাধাকেষ্টপুর, গণেশপুর। এলাকার অন্যতম ব্যস্ত জায়গার নাম রথবাজার। জনগণের ইতিহাস শুধু ভোটের প্রচারপত্রে থাকে না। সে সর্বত্র নিঃশব্দে বিরাজমান। এলাকার বিধায়ক কংগ্রেসের, পঞ্চায়েত সমিতি তৃণমূলের। সেই দলের হয়ে আগে জেলার দেখভাল করতেন শুভেন্দু অধিকারী। এখন? পঞ্চায়েত সভাপতি হাসলেন, ‘‘আর যাই হোক, হাঙ্গামা বাধাতে দেব না। লালগোলার ঐতিহ্য অটুট রয়ে যাবে।’’

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy