ইডি-র চার্জশিটে অভিযোগ করা হয়েছে, চাকরি বিক্রির যুগলবন্দি চালিয়ে গিয়েছিলেন কুন্তল ঘোষ এবং শান্তনু বন্দ্যোপাধ্যায়। ফাইল চিত্র।
শিক্ষায় নিয়োগ দুর্নীতির মামলায় প্রাক্তন শিক্ষামন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায় ও প্রাথমিক শিক্ষা পর্ষদের অপসারিত সভাপতি মানিক ভট্টাচার্যের গ্রেফতারির পরেও শিক্ষক পদে চাকরির টোপ দিয়ে এক ‘দাদা-ভাইয়ের’ মানিকজোড় দেদার টাকা তুলেছেন বলে অভিযোগ। ইডি-র চার্জশিটে অভিযোগ করা হয়েছে, চাকরি বিক্রির সেই যুগলবন্দি চালিয়ে গিয়েছিলেন কুন্তল ঘোষ এবং শান্তনু বন্দ্যোপাধ্যায়। শাসক দলের যুব নেতা থাকাকালীন যে-শান্তনু ছিলেন স্বঘোষিত ‘দাদা’ এবং কুন্তল তাঁর বাঁকা পথের সদাসঙ্গী ‘লক্ষ্মণভাই’।
চার্জশিটে ইডি-র অভিযোগ, উঁচু মহলের কিছু ‘বড় মাথা’র হাত মাথায় থাকায় শাসক দলের যুব নেতা (গ্রেফতারের পরে বহিষ্কৃত) হওয়ার সুবাদে কুন্তল ২০১৪ সালের প্রাথমিক স্কুলের নিয়োগ পরীক্ষা টেট থেকেই টাকা নিয়ে চাকরি বিক্রির খেলায় মেতেছিলেন। কিন্তু প্রাক্তন শিক্ষামন্ত্রী ও পূর্বতন পর্ষদ-সভাপতির মতো দু’জন যখন জেলে, তখনও কুন্তল-শান্তনু যুগল সমানে টাকা তুলে গেলেন কী ভাবে, সেটা এক বিস্ময়। ইডি হতবাক এই কারণে যে, এত দুঃসাহস ওই দু’জনের হল কী করে? তা হলে কি এমন বেপরোয়াপনা চালিয়ে যাওয়ার মতো সাহস এমন কেউ জুগিয়েছেন, যিনি অধিকতর ‘বড় মাথা’? সেই বৃহত্তর মাথা এক বা একাধিক কি না, হতবাক ইডি-র প্রশ্ন সেটাই এবং আপাতত সেই খোঁজ চালানো হচ্ছে বলে জানাচ্ছে তারা।
চার্জশিটে ইডি-র অভিযোগ, পার্থ ও মানিকের গ্রেফতারির পরেও প্রতারণার খেলা থামেনি কুন্তলদের। ভয় পাওয়া বা পিছু হটা তো দূরের কথা, সেই অবস্থায় ২০২২ সালের নভেম্বরে আয়োজিত টেটের প্রার্থীদের কাছেও সমানে চাকরির টোপ দিয়ে গিয়েছেন কুন্তল। ইডি চার্জশিটে জানিয়েছে, ওই অভিযুক্ত এতটাই বেপরোয়া ছিলেন যে, ২০২২ সালেও সেই আবহে চাকরির আশ্বাস দিয়ে কর্মপ্রার্থীদের কাছ থেকে টাকা তুলেছিলেন! বিশেষ করে যে-সব চাকরিপ্রার্থী পূর্ববর্তী টেটে বসে টাকা দিয়েও চাকরি পাননি, ফের টাকা নিয়ে তাঁদের ২০২২-এর টেটে বসিয়েছিলেন কুন্তলেরা। এবং সইটুকু করে সাদা ‘ওএমআর শিট’ বা উত্তরপত্র জমা দিতে বলেছিলেন। তদন্তকারীদের দাবি, নিয়োগ দুর্নীতিতে প্রাথমিক, সহ-শিক্ষক, নবম-দশমের শিক্ষক, ‘গ্রুপ সি’ বা তৃতীয় শ্রেণি এবং ‘গ্রুপ ডি’ বা চতুর্থ শ্রেণির শিক্ষাকর্মীর পদে বেপরোয়া ভাবে দুর্নীতি চালিয়েছিলেন কুন্তল ও শান্তনু। রাজ্য জুড়ে নিয়োগ দুর্নীতি কাণ্ডে যখন শিক্ষা দফতরের প্রাক্তন কর্তাদের অনেকে গ্রেফতার হচ্ছেন, শোরগোল চলছে চতুর্দিকে, কতটা ‘সাহস’ থাকলে সেই আবহেও টাকা তোলা যায়! তদন্তকারীদের প্রশ্ন, তবে কি মাথার উপরে এমন কোনও অধিকতর প্রভাবশালীর হাত ছিল, যাঁর বদান্যতায় এমন বেপরোয়া হয়ে উঠতে পেরেছিলেন কুন্তল?
ইডি-র দাবি, ২০২২ সালের নভেম্বরে কড়া নজরদারিতে প্রাথমিক টেট হয়েছে বলে দাবি করেছিলেন প্রাথমিক শিক্ষা পর্ষদের কর্তারা। অথচ কুন্তলের বিরুদ্ধে আদালতে পেশ করা ১০৪ পাতার চার্জশিটের ৩৯ ও ৪০ পাতায় তদন্তকারীরা জানিয়েছেন, কুন্তলের ফ্ল্যাট থেকে ২০২২ সালের টেটের ২৬৭ জন প্রার্থীর উত্তরপত্র পাওয়া গিয়েছে। সেই সঙ্গে মিলেছে চাকরিপ্রার্থীদের অ্যাডমিট কার্ড এবং রেজিস্ট্রেশনের নথিও। বাজেয়াপ্ত করা সেই সব ওএমআর শিটে উত্তর লেখার জায়গা ছিল বেবাক ফাঁকা। সেই প্রায় সাদা খাতায় কালির আঁচড় বলতে নীচে পরীক্ষার্থীদের সইটুকু!
তদন্তকারীদের দাবি, জেরায় কুন্তল জানিয়েছেন, ওই সব চাকরিপ্রার্থী ২০১৪ সালে টেটে বসে পাশ করতে পারেননি। তাঁদের কাছ থেকে টেট পাশ ও প্রাথমিক স্কুলে নিয়োগ বাবদ সে-বার মাথাপিছু অগ্রিম দু’লক্ষ টাকা নেওয়া হয়েছিল। চাকরি না-পাওয়ায় পরবর্তী পর্যায়ে ‘আরটিআই’ বা তথ্য জানার অধিকার আইনে আবেদন করা হয় এবং আরও পরে নম্বর বাড়ানোর আবেদন করা হয় আদালতে। কিন্তু আইনি জটিলতায় কোনও কার্যকর পদক্ষেপ সম্ভব হয়নি। চাকরি হয়নি সেই ২৬৭ জন অযোগ্য প্রার্থীর।
তদন্তকারীদের দাবি, ২০২২ সালে আবার চাকরির প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয় ওই প্রার্থীদের। অভিযোগ, ওই সব প্রার্থীকে তখনই সাদা খাতা জমা দিতে বলা হয়েছিল। আশ্বাস দেওয়া হয়, পরে উত্তরপত্রে ঠিক উত্তর লিখে মূল্যায়নের ব্যবস্থা করা হবে। সেই প্রক্রিয়ার শুরুতে কুন্তলের কাছে রাখা ছিল ওই প্রার্থীদের সাদা উত্তরপত্র।
ইডি সূত্রের দাবি, যে-দু’জন ‘মিডলম্যান’ বা দালালের মাধ্যমে ওই ২৬৭ জন প্রার্থী কুন্তলের সঙ্গে যোগাযোগ করেছিলেন, তাঁদের বয়ান লিপিবদ্ধ করা হয়েছে। বয়ান নেওয়া হয়েছে সেই প্রার্থীদেরও। সেই সব বয়ান থেকে জানা যায়, ২০১৪ সালে
টেট পাশ করতে না-পারা অযোগ্য প্রার্থীদের কাছ থেকে চাকরির প্রতিশ্রুতি দিয়ে আগেই মাথাপিছু প্রায় দু’লক্ষ টাকা নিয়েছিলেন কুন্তল ও শান্তনু (এখন জেল হেফাজতে)।
তদন্তকারীদের দাবি, ২০২২ সালের নভেম্বরে নতুন টেটের নির্ঘণ্ট ঘোষণার পরেই কুন্তল ওই ২৬৭ জন অযোগ্য প্রার্থীর প্রত্যেকের কাছ থেকে আবার ২০ হাজার টাকা অগ্রিম নেন। ঠিক হয়, এ বার চাকরি পাওয়ার পরে ওই প্রার্থীরা প্রত্যেকে আরও এক লক্ষ ৮০ হাজার টাকা দেবেন। কুন্তলের কাছ থেকে যাঁদের সাদা উত্তরপত্র উদ্ধার করা হয়েছে, সেই ২৬৭ জন চাকরিপ্রার্থীর বিষয়ে প্রাথমিক শিক্ষা পর্ষদে চিঠি দিয়ে খোঁজখবর নেওয়া হচ্ছে। ওই প্রার্থীরা পাশ করেছেন কি না, খতিয়ে দেখা হচ্ছে তা-ও।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy