অলংকরণ: শৌভিক দেবনাথ।
পশ্চিমবঙ্গের সরকারি হাসপাতালগুলিতে ‘ওয়ার্ড মাস্টারে’র পদে চাকরি পেতে আবেদন করেছেন সানি লিওনি! শুরুতেই মাইনে ২৫ হাজার টাকা। সানি ছাড়াও অ্যাপ্লাই করেছেন সাড়ে তিন লক্ষ আবেদনকারী।
তার মধ্যে সাড়ে আট হাজার জনের একটি বাছাই তালিকা প্রকাশ করেছে রাজ্যের স্বাস্থ্য দফতর। সেই তালিকায় যে আবেদনকারীর নাম রয়েছে প্রথমে, তিনি অনলাইনে আবেদনের সময় তাঁর নাম জানিয়েছেন, ‘হেলো’। তাঁর বাবার নাম- ‘হে’। গ্র্যাজুয়েশনে তিনি কত নম্বর পেয়েছিলেন শুনলে আপনার চোখ কপালে উঠে যাবে! ৯৬.২২ শতাংশ! উচ্চ মাধ্যমিকে তিনি আরও এগিয়ে গিয়েছেন ১০০-র দিকে। পেয়েছেন ৯৭.৮ শতাংশ! রাজ্যের বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে গ্র্যাজুয়েশনে এত নম্বর দেয়, কখনও শুনেছেন?
স্বাস্থ্য দফতরের প্রকাশিত সেই তালিকায় দ্বিতীয় নামটি যাঁর, তিনি এক জন মহিলা। তাঁর বাবার নামের সঙ্গে কোনও ফারাক নেই মেয়ের নামের। বাবার নাম ‘পায়েল ঘোষ মণ্ডল’। মেয়েরও তাই! বঙ্গে কোনও পুরুষের নাম ‘পায়েল’ হয়, শুনেছেন কখনও?
সোশ্যাল মিডিয়া তোলপাড় আবেদনকারীদের পরিচয়, শিক্ষাগত যোগ্যতার দাবিদাওয়া নিয়ে। ফেসবুক, টুইটারে প্রশ্ন উঠেছে, কেন? রাজ্যে সরকারি চাকরির বিজ্ঞাপনের প্রেক্ষিতে কেন এই সব রঙ্গ, রসিকতা? বেসরকারি কর্মক্ষেত্রে উত্তরোত্তর বিপন্নতা বাড়ছে। ‘তেমন ঝুঁকি নিতে হয় না’ এই প্রজন্মলালিত বোধ সরকারি চাকরির প্রতি বাঙালির মোহ, আগ্রহকে কোনও দিনই কমতে দেয়নি। মাইনে যা হোক, নিরাপত্তা আছে, হুট বলতে চাকরি যাবে না, হঠাৎ বদলি-টদলি হয়ে গেলেও রাজনীতিকদের তদ্বির করে নিজেকে বাঁচিয়ে নেওয়া যাবে, চাকরিতে ছুটিছাটা আছে। আছে হাত, পা ছড়িয়ে আয়েশে চাকরি করা যাবে, এই ধারণা থেকেই তো বাঙালির কাছে এত আদরের সরকারি চাকরি।
তাই প্রশ্ন উঠছে, কোন হতাশা থেকে, কোন হীনম্মন্যতা থেকে সেই সরকারি চাকরি নিয়েও তুচ্ছ, তাচ্ছিল্য করার পর্যায়ে পৌঁছে গিয়েছে বাঙালি?
ভাবুন, তালিকায় ঢুকে পড়েছেন কৃষ্ণ, সুদামাও! পাঁচ নম্বরে। আবেদনকারী ‘কৃষ্ণ’ বাবার নাম লিখেছেন, ‘সুদামা’! সোশ্যাল মিডিয়ায় আলাপ, আলোচনা চলছে, সেই ‘কলির কৃষ্ণ’-র রেজাল্ট নিয়ে। সেখানে এখন একটাই প্রশ্ন, যাবতীয় ‘লীলা-টিলা’ ভুলে, একটুও ‘ননি, মাখন’ চুরি না করে, ‘কলির কৃষ্ণ’ কি শুধুই কাটিয়েছেন বইয়ে মুখ গুঁজে। ২৫০ টাকা জমা দিয়ে অনলাইনে আবেদন করতে গিয়ে কৃষ্ণ জানিয়েছেন, উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষাকে তিনি কার্যত তুড়ি মেরেই উড়িয়ে দিয়েছিলেন। পাঁচটি পেপারে পেয়েছিলেন ৯৯.৫ শতাংশ নম্বর! মাত্রই আধ শতাংশ নম্বর কাটতে পেরেছিলেন পরীক্ষকরা। তিনি মাধ্যমিকে পান ৮৮ শতাংশ। সোশ্যাল মিডিয়ায় কটাক্ষ, কেন যে মাধ্যমিকের পর রাজ্যে উচ্চ মাধ্যমিকে ড্রপ আউটের সংখ্যা বাড়ছে, কে জানে!
ঘটনাকে কটাক্ষ করে রাজ্য বিজেপির সভাপতি দিলীপ ঘোষ বৃহস্পতিবার একটি অনুষ্ঠানে বলেছেন, ‘‘এখানে (পশ্চিমবঙ্গ) কি কোনও সরকার চলছে? আদতে সার্কাস চলছে এই রাজ্যে!’’
আরও পড়ুন- নিশানা শুধুমাত্র মমতা, অনৈক্য সামলান: বঙ্গ বিজেপিকে হুঁশিয়ারি শাহের
আরও পড়ুন- হাজরায় মমতার উপর হামলা, ২৯ বছর পর ‘প্রমাণের অভাবে’ বেকসুর খালাস লালু আলম
তালিকায় যিনি রয়েছেন আট নম্বরে সেই আবেদনকারী ‘দীপক রায়’ তাঁর বাবার নামটি রেখেছেন তাঁর নামেই। দীপক। কিন্তু নিজের ‘রায়’ পদবির আভিজাত্যটা আর বাবাকে দিতে রাজি হননি! তাই বাবার নাম লিখেছেন, ‘দীপক সেন’। এটা কি বাবার পদবি অনায়াসে বদলে দেওয়ার ‘সার্কাস’?
আবেদনকারীদের অন্যতম তাঁর বাবার নাম লিখেছেন, ‘XXXX’। আর এক জন আবেদনকারী জানিয়েছেন, গ্র্যাজুয়েশনে তিনি পেয়েছেন ১০০ শতাংশ নম্বর!
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ‘‘এই হাসি, ঠাট্টা, মশকরার খেলাটা চালু হয়েছে আদতে গভীর হতাশা বোধ থেকে। এই রাজ্যে তো কিছুই হবে না, দাদা-দিদিদের না ধরলে, পিছনে কোনও শক্তপোক্ত সুপারিশ না থাকলে সরকারি চাকরি জুটবে না, জুটলেও আচমকা বদলি হয়ে যেতে হবে পাহাড়ে বা জঙ্গলে, এই ধারণাই জোরালো হয়ে উঠছে বাঙালির ঘরে ঘরে। এর মধ্যে কোনও বিশেষ একটি প্রজন্ম নেই। এটা বাঙালি জাতির হালের সমস্যা।’’
সরকারি হাসপাতালগুলিতে ‘ওয়ার্ড মাস্টার’-এর পদটিরও নাম বদলে এ বার তাকে একটু কেতাদুরস্ত করার চেষ্টা করেছিল স্বাস্থ্য দফতর। পদটির পোশাকি নাম দেওয়া হয়েছে, ‘ফেসিলিটি ম্যানেজার’। ৮১৯ জনকে নিয়োগ করতে চেয়ে বিজ্ঞপ্তি দিয়েছিল ওয়েস্ট বেঙ্গল হেল্থ রিক্রুটমেন্ট বোর্ড। ন্যূনতম যোগ্যতা স্নাতক। গত ১৪ ফেব্রুয়ারি প্রকাশিত সেই বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, ‘ফেসিলিটি ম্যানেজার’-এর চাকরি পেলে এন্ট্রি-পে হবে ৭ হাজার ৪৪০ টাকা। আর গ্রেড পে হবে ৩ হাজার ৬০০ টাকা। স্বাস্থ্য কর্তাদের হিসাবে, শুরুতে সব মিলিয়ে ২৫ হাজার টাকা তো পাবেনই নতুন চাকুরে। মঙ্গলবার রিক্রুটমেন্ট বোর্ডের ওয়েবসাইটে তালিকাটি প্রকাশিত হয়েছে।
সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রশ্ন উঠেছে, কটাক্ষ করা হচ্ছে, অনলাইনে আবেদন করতে তো ২৫০ টাকা লাগছে। তা হলে পকেটের পয়সা খরচ করে কেন এই ভাবে আবেদন করলেন তরুণ প্রজন্ম? তা কি কোনও হতাশা থেকে? রাজ্য সরকারের উপর আস্থা ও বিশ্বাস হারিয়ে? নিয়োগ প্রক্রিয়ার উপর ভরসা হারিয়ে? কোনও হীনম্মন্যতার শিকার হয়ে?
বিশিষ্ট মনোরোগ চিকিৎসক কেদার বন্দ্যোপাধ্যায় বললেন, ‘‘এই বিচিত্র ঘটনার কথা শুনে অবাক হয়ে গেলাম। রাজ্য সরকারি চাকরি সম্পর্কে তরুণ প্রজন্মের মধ্যে যে একটা তাচ্ছিল্য এসে গিয়েছে, এই ঘটনাতেই তা বোঝা যাচ্ছে। যাক না আড়াইশোটা টাকা। রাজ্য সরকারের চাকরি নিয়ে হাসি, ঠাট্টা, মস্করার এই তো সুযোগ। কিছুই তো হবে না এই রাজ্যের! আমার ধারণা, এই মানসিকতা থেকেই এক ধরনের হীনম্মন্যতার শিকার হয়েছেন তরুণ প্রজন্মের ওই অংশটি।’’
সোশ্যাল মিডিয়ায় এই প্রশ্নও তোলা হয়েছে, সাড়ে তিন লক্ষ আবেদনকারীদের মধ্যে থেকে ওই সব নামধাম দেখেও কী ভাবে বাছাই তালিকায় রাখা হল সাড়ে আট হাজার নাম? নাম বাছাইয়ের ক্ষেত্রেও কি বিবেচনার পরিচয় দিতে নারাজ রাজ্য স্বাস্থ্য দফতরের কর্তা, কর্মীরা?
একই প্রশ্ন তুলেছেন কেদারও। তাঁর কথায়, ‘‘যে সরকারি কর্মী, কর্তারা ওই সব ভুয়ো নামের থেকে একটি বাছাই তালিকা তৈরি করলেন, তাঁরাই বা কী ভাবে ওই নামগুলি রাখলেন তালিকায়? ওই ধরনের বিচিত্র নামধাম দেখে তাঁদেরও তো ভ্রূকুঞ্চন হওয়ার কথা ছিল! ফলে, রাজ্যের সরকারি কর্মী, কর্তারা কতটা কী কাজ করেন, তা নিয়ে পুরনো প্রশ্নটা আরও জোরালো ভাবেই উঠে গেল।’’
বিষয়টি নিয়ে সোশ্যাল মিডিয়ায় আলোড়নের প্রেক্ষিতে অবশ্য স্বাস্থ্য দফতরের একটি বক্তব্য রয়েছে। এক কর্তার কথায়, ‘‘কেউ ভুল তথ্য দিলে, তা নথি যাচাইয়ের সময় ধরা পড়বে। সে ক্ষেত্রে আবেদন যে বাতিল হয়ে যাবে, তার উল্লেখ রয়েছে বিজ্ঞাপনে।’’
এইখানেই প্রশ্ন তুলেছেন বিশিষ্ট মনোবিদ অনুত্তমা বন্দ্যোপাধ্যায়। তাঁর প্রশ্ন, ‘‘এটুকু করলেই সরকারি কর্মী, কর্তাদের দায়িত্ব শেষ হয়ে যায়? হতে পারে, তাঁরা ভেবেছিলেন, এটা তো প্রার্থী বাছাইয়ের প্রাথমিক ধাপ। অনেক বেনোজল ঢুকবে। তার পর ফের ঝাড়াই-বাছাই হবে। এখন আর অত সব দেখেটেখে কী হবে? কিন্তু সেটাও তো তাঁদের দায়িত্বহীনতাই। আমার মনে হয়, এই দায়িত্বহীনতার অভাবটা এই ঘটনায় দু’দিক থেকেই প্রকট হয়েছে। বলা ভাল, দ্বিপাক্ষিক দায়িত্বহীনতা।’’
সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রশ্ন, কেন এই বিচিত্র প্রবণতা দেখা গেল রাজ্যের তরুণ প্রজন্মের মধ্যে? যাঁরা এই ধরনের কাণ্ড ঘটালেন, তাঁদের কোন স্বার্থ চরিতার্থ হল?
অনুত্তমা বলছেন, ‘‘আমি এটাকে কোনও বিশেষ প্রজন্মের, তরুণ প্রজন্মের সমস্যা বলে মেনে নিতে রাজি নই। কারণ, চাকরির আবেদনগুলি তো এসেছে অনলাইনে। সরকারি কর্তৃপক্ষই জানিয়েছেন, সেগুলির তথ্যাদি যাচাই না করেই তাঁরা প্রাথমিক ভাবে একটি বাছাই তালিকা প্রকাশ করেছেন। তা হলে তো প্রবীণদের মধ্যেও কেউ এই ধরনের হাসি, ঠাট্টা, মশকরা করতে পারেন। ল্যাপটপ, মোবাইল সকলের ধরাছোঁয়ার মধ্যে এসে গিয়েছে বলে এমনকি, স্কুলের গণ্ডি না পেরনো ছাত্রছাত্রীরাও এমনটা করতে পারে।’’
অনুত্তমা এ-ও জানিয়েছেন, মানুষকে হেয় করা, অযথা তাঁকে নিয়ে ‘মিম’ বানানো, কাউকে অযথা ‘ট্রোল’ করা, এই সব তো এখন রেওয়াজ হয়ে দাঁড়িয়েছে সোশ্যাল মিডিয়ায়। প্রবীণ ও মহিলাদের মর্যাদা দেওয়ার স্বাভাবিকতা থেকে সোশ্যাল মিডিয়ার কল্যাণে যেন অনেকটাই বেরিয়ে এসেছে বঙ্গসমাজ।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy