পালানোর উপায় নেই যাঁদের, বগটুইয়ে রয়ে গিয়েছেন তাঁরাই। ছবি: সব্যসাচী ইসলাম
রান্নার সময় দু’মুঠো চাল বেশি নিচ্ছেন ওঁরা। প্রতিবেশীকে অভুক্ত রেখে খাবার মুখে তোলা যায় নাকি! উপপ্রধান খুনের পরে যে গ্রামে একের পর এক বাড়িতে আগুন জ্বলেছিল, সেই বগটুইয়েই প্রতিবেশীর জন্য খাবার রেঁধে-বেড়ে অপেক্ষা করছেন কিছু মহিলা। কেউ করেছেন রাতে থাকার বন্দোবস্ত। রবিবার বগটুই ঘুরে মানবিকতার এই ছবিও সামনে এল।
২১ মার্চ রাতে উপপ্রধান ভাদু শেখ খুনের পরে রামপুরহাট শহর লাগোয়া বগটুই গ্রামে আট জনকে পুড়িয়ে মারা হয়। এক রাতে ন’জন খুনের পরে আতঙ্কে গোটা গ্রাম কার্যত পুরুষ-শূন্য হয়ে পড়ে। অনেকে পরিবার, বাড়ি ছেড়ে নিরাপদ আশ্রয়ে চলে যান। সেই সব বাড়ি এখনও তালাবন্ধ হয়ে রয়েছে। কিন্তু, ঘটনার সপ্তাহ পার করেও একা আছেন অনেকে। গ্রাম ঘুরে জানা গেল, সেই তালিকায় কিছু মহিলাও রয়েছেন। পড়শিরা দাঁড়িয়েছেন তাঁদেরই পাশে।
বগটুই গ্রামের ঘটনাস্থলের কাছে বাড়ি বেদনা বিবির। বাড়ি লাগোয়া দোকানও আছে। সকালের দিকে কয়েক ঘণ্টা দোকান খোলা রাখছেন। এক ছেলে হায়দরাবাদে কাজ করেন। মেয়ে বিবাহিত। তাঁর দাবি, “রাতে ভয়ে বাড়িতে থাকি না। পাশে এক জনের ঘরে রাতটুকু কাটাই।” এই বাড়ি থেকে কিছু দূরে একটা পুকুর পাড়ে থাকেন সেলিনা বিবি। রামপুরহাট শহরে জাতীয় সড়কের ধারে ধাবায় দৈনিক মজুরিতে কাজ করেন। তাঁর কথায়, “গ্রামের ঘটনার পরে হোটেলে কাজে আসতে বারণ করেছে। আমার তো খাবারও সংস্থান নেই। পড়শি বাড়ি থেকে খাবার আসছে।’’ পাশে দাঁড়িয়ে ছিলেন হাসান বিবি। তিনি বলছেন, “পরিচারিকার কাজ করি। এখন কেউ কাজেও নিচ্ছে না। কয়েক দিন ধরে পড়শিরা খাবার দিচ্ছেন।” রওসনা বিবিও জানালেন, রামপুরহাট থেকে বাজার করে আনার সাহস হয়নি। তাঁকেও পাশের বাড়ি থেকে খাবার দিচ্ছে।
রবিবার দুপুরে তখন রান্নায় ব্যস্ত রজিনা বিবি, সোহনা বিবিরা। তাঁরা বলছেন, “আমরা রান্না করে খাচ্ছি। আমাদের ছেলে-মেয়েরাও খাবার পাচ্ছে। আর পাশের বাড়ির চাচি-ফুফারা খেতে পাবে না, সেটা হয় নাকি। তাই ওঁদের জন্যও দু’মুঠো চাল বেশি নিচ্ছি।”
এ দিকে, ঘটনার এক সপ্তাহ পরে মুখ্যমন্ত্রীর আশ্বাসে কিছু পরিবার গ্রামে ফিরেছে। গ্রামের রাস্তায় পুলিশের ছড়াছড়ি। হাই কোর্টের নির্দেশ মতো নজর ক্যামেরাও বসানো হচ্ছে। ৩১টির পরে এ দিন নতুন করে ১৮টি ক্যামেরা বসানোর কাজ চলছে। বিভিন্ন মোড়ে পুলিশের পিকেট। তার পরেও ‘ভয়’ কাটেনি গ্রামের অনেকের। রাতে বাড়িতে থাকতে চাইছেন না এঁরা। পড়শির বাড়িতে, পাশের পাড়ায় কিংবা আত্মীয়ের বাড়িতে এক জোট হয়ে রাত কাটাচ্ছেন। রাখি বিবি, হাসানুজ বিবিরা বলছেন, “সাতে-পাঁচে থাকি না। এখন দিনের বেলায় চেয়েচিন্তে খাওয়াদাওয়া করি। তবে রাতে থাকার সাহস এখনও হয়নি।”
হতাশ ফটিক শেখও। প্রতিদিন সাইকেলে বগটুই ঘুরে মাছ বিক্রি করেন বেনেগ্রামের এই ব্যবসায়ী। কয়েক দিন গ্রামের পথ ধরেননি তিনি। ফটিক বলছেন, “অনেক দিন বাদে রবিবার এলাম। গ্রামে এলে প্রায় ১২ কেজি মাছ বিক্রি হয়। হাঁক পাড়লেও এ দিন কেউ দরজা খোলেনি। মাত্র ৭০০ গ্রাম মাছ বিক্রি হয়েছে।’’ ভ্যানে করে আনাজ বিক্রি করেন সইফুল শেখ। ইদগাহ মোড়ে দাঁড়িয়ে তাঁর আক্ষেপ, “গ্রামের লোক তো ভয়ে সিঁটিয়ে। আনাজ কিনবে কে?’’
রান্না করা খাবার থেকে রাতের আশ্রয় নিয়ে পড়শির পাশে অবশ্য নির্ভয়েই দাঁড়াচ্ছেন রজিনা বিবি, সোহনা বিবিরা।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy