যুযুধান দুই তৃণমূল নেতা তাপস চট্টোপাধ্যায় ও সব্যসাচী দত্তের সম্পর্কের টানাপড়েনের জেরে ফের তেতে উঠেছে নিউ টাউন বিধানসভা কেন্দ্র এলাকার নারায়ণপুর তথা রাজারহাটের রাজনৈতিক মহল। আগামী বছর রাজ্যে বিধানসভা নির্বাচন। তার আগে নারায়ণপুরে গুলি চলার ঘটনা কি দুই নেতার মধ্যে জমি দখল নিয়ে লড়াইয়েরই ইঙ্গিত দিল?
২০১১ সালে রাজ্যে পালাবদলের সময় থেকেই রাজারহাট-নিউ টাউনে সব্যসাচী ও তাপসের রাজনৈতিক দ্বৈরথের কথা সকলের জানা। সেই সময়ে সিপিএমের প্রার্থী তাপসকে হারিয়ে নিউ টাউনের বিধায়ক হয়েছিলেন সব্যসাচী। পরবর্তী কালে তাপস তৃণমূলে যোগ দিয়ে ২০১৫ সালে বিধাননগরের তৎকালীন মেয়র সব্যসাচীর নেতৃত্বাধীন পুরসভার ডেপুটি মেয়র হন। তা সত্ত্বেও একাধিক ক্ষেত্রে দু’জনের মধ্যে মতানৈক্য দেখা যেত। ২০২১ সালে সব্যসাচী বিজেপিতে যোগ দেওয়ায় নিউ টাউনের বিধায়ক হন তাপস।
ওই বিধানসভা কেন্দ্র এলাকার দক্ষিণ নারায়ণপুরে গত শুক্রবার এক তৃণমূল কর্মীর বাড়ির বাইরে গুলি চলে, বাড়িও ভাঙচুর করা হয়। আজাদ বাবা নামে ওই ব্যক্তি নিউ টাউনের প্রাক্তন তৃণমূল বিধায়ক সব্যসাচী দত্তের অনুগামী বলে নিজের পরিচয় দিয়েছেন। আজাদের অভিযোগ, ইদের দিন সব্যসাচী তাঁর বাড়িতে আসায় স্থানীয় বিধায়ক তাপসের নির্দেশে তাঁর অনুগামীরা ওই হামলা চালিয়েছে। সেই ঘটনায় তাপসের ঘনিষ্ঠ শেখ আজাদ নামে এক ব্যক্তির বিরুদ্ধে হামলার অভিযোগ করেছেন ওই তৃণমূল কর্মী। শেখ আজাদের বিরুদ্ধে আবার মাদক পাচারের অভিযোগ করেছেন সব্যসাচী। এই পরিস্থিতিতে গত শুক্রবারের ঘটনা ইঙ্গিতপূর্ণ বলেই মনে করছেন অনেকে।
বর্তমানে সল্টলেক ছেড়ে সব্যসাচী তাপসের খাসতালুক রাজারহাট-নিউ টাউনে নিজের ফ্ল্যাটে বসবাস শুরু করেছেন। সব্যসাচী বলেন, ‘‘এটা আমার বাড়ি। আমি তো এখানেই থাকব।’’ কিন্তু তাপসের অনুগামীরা বিষয়টি অরাজনৈতিক বলে মেনে নিতে নারাজ।
ঘটনাচক্রে, সব্যসাচীর ঘনিষ্ঠ ওই ব্যক্তির বাড়িতে হামলার আগের রাতে তাপসের একটি বক্তৃতার ভিডিয়োয় দেখা যাচ্ছে, তিনি এক ব্যক্তির উদ্দেশে তীব্র প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করছেন। তাপসকে বলতে শোনা যাচ্ছে, ‘‘উপর থেকে কত ফুল ফেলবেন ফেলুন। সেই ফুল কাঁটা হয়ে উঠবে। আমরাও জানি, মানুষকে ফুল দিতে। তাপস চ্যাটার্জি সিমাই খাওয়ার যোগ্য নয়? এতই যদি ভাল, তবে বেআইনি ভাবে প্রোমোটিং করছ কেন? এত টাকা রোজগার করেছ, এ বার খরচ করো মানুষের জন্য। এটা আমার নিজের নারায়ণপুর, অন্য কোথাও কিছু হলে দেখতে যাব না। এ সব লোকজনকে বয়কট করুন। অনেক সহ্য করেছি। প্রয়োজনে পদ ছেড়ে লড়াই করব। লড়াই হবে, লড়াই শুরু হয়ে গিয়েছে, মাঝামাঝি কোনও জায়গা নেই। সবাই তৈরি থাকুন।’’
সব্যসাচীর ঘনিষ্ঠ ওই পরিবারের সদস্যদের দাবি, তাপসের সেই সভা ছিল তাঁদের বাড়ির অদূরে। কথাগুলোও তাঁদের উদ্দেশে বলা। স্থানীয়েরা জানান, ইদের দিন সেখানে সব্যসাচীকে ফুল ছুড়ে বরণ করা হয়। তাই তাপসের বক্তব্যে ফুলের প্রসঙ্গ এসেছে। অতীতে সব্যসাচী নিউ টাউনের বিধায়ক থাকাকালীন তাপসের অনুগামীদের অনেককেই নারায়ণপুর তল্লাটে কোণঠাসা করে দেওয়া হয়েছিল। এমনকি, রাজ্যে পালাবদলের পরে সিপিএমে থাকার সময়ে সব্যসাচীর সঙ্গে একটি গোলমালকে কেন্দ্র করে তাপস এলাকাছাড়া হয়ে যান। একাধিক মামলা তাঁর বিরুদ্ধে রুজু করে পুলিশ। এ বিষয়ে তাপস অবশ্য বলেন, ‘‘দলের উপর মহল ঘটনাটি দেখছে। আমি আর কিছু বলব না।’’
স্থানীয় রাজনৈতিক মহলের দাবি, দলীয় অনুশাসন মেনে সরাসরি দ্বৈরথে না নামলেও গত এক দশকের বেশি সময় পরেও দু’জনের সম্পর্কে কোনও উন্নতি ঘটেনি। ফলে লড়াইয়ের যে হুঙ্কার তাপস সে দিনের সভায় দিয়েছেন, তা রাজনৈতিক ভাবে ইঙ্গিতপূর্ণ বলেই মনে করা হচ্ছে।
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)