মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।
সরকারি প্রকল্পে বাড়ি পেতে ‘নজরানা’ দিতে আপত্তি নেই— প্রস্তাব ছিল এমনই। পশ্চিম মেদিনীপুরের কেশপুরের এক বাসিন্দার সে প্রস্তাবে আঁতকে উঠলেন এলাকার তৃণমূলের জন প্রতিনিধি। নেতার কথায়, ‘‘এমনিই বাড়ি পাবেন। কাটমানি নিয়ে যা হল!’’
মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যে দিন থেকে পরিষেবা পাইয়ে দেওয়ার নামে টাকা দেওয়া-নেওয়া প্রতিরোধ করতে বলেছেন, রাজ্যে শোরগোল ফেলেছে ‘কাটমানি’ বিক্ষোভ। সরকারি পরিষেবার সুবিধা দিতে শাসকদলের নেতারা ‘কাটমানি’ নিয়েছেন, এমনই অভিযোগ তুলেছেন বিরোধীরা। টাকা ফেরত চেয়ে বিক্ষোভে শামিল হয়েছে জনতা। প্রায় সর্বত্র ‘রাজনৈতিক কারণে তাঁদের গায়ে কাদা ছেটানোর চেষ্টা হচ্ছে— দাবি তৃণমূলের নেতাদের। তবে রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্তে অনেকে সতর্ক। প্রভাব পড়ছে সরকারি প্রকল্পের গতিতে।
উত্তরবঙ্গের রায়গঞ্জ বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘কাটমানি’ নেওয়ার অভিযোগ ওঠার পরে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ একটি নিয়োগ প্রক্রিয়া স্থগিত করে দেন। মালদহের হরিশ্চন্দ্রপুরে একই কারণে থমকেছে জল প্রকল্পের কাজ। কোচবিহারে আটকে রয়েছে
সরকারি প্রকল্পের ঘর বিলি। একই অভিযোগের দৌলতে চলতি অর্থবর্ষে বীরভূমে আবাস যোজনায় বাড়ি পেতে দেরি হয়েছে অনেকের। অনেক পঞ্চায়েতে ১০০ দিনের প্রকল্প সে ভাবে শুরু হয়নি।
পূর্ব বর্ধমানের কেতুগ্রামে গঙ্গাটিকুরি পঞ্চায়েত এলাকার বাসিন্দা গোলক হাজরা, মঙ্গল হাজরাদের অভিযোগ, ২০১৭-১৮ অর্থবর্ষে শৌচাগারের জন্য আবেদন জানিয়েছিলেন তাঁরা। এখনও তা মেলেনি। অভিযোগ, ওই অর্থবর্ষেই যাঁদের পাকা বাড়িতে শৌচাগার রয়েছে, স্থানীয় তৃণমূল নেতারা ‘কাটমানি’ নিয়ে তাঁদেরও প্রকল্পের সুবিধা পাইয়ে দিয়েছেন। তাঁদের আরও দাবি, গত অর্থবর্ষে জুলাই, অগস্ট-সহ বছরের নানা সময়ে পঞ্চায়েত ‘ইন্দিরা আবাস যোজনা’-র মতো বিভিন্ন প্রকল্পের বিষয়ে মাইক-সহযোগে প্রচার করত। সুপারভাইজ়ারদের মাধ্যমে প্রয়োজনীয় ফর্ম পূরণও করানো হত। এ বার এখনও পর্যন্ত সেখানে কোনও প্রকল্পের বিষয়ে পঞ্চায়েত প্রচার করেনি। দেখা নেই সুপারভাইজ়ারদেরও। গোলকবাবুদের মতে, ‘‘এ সব কাটমানি-বিক্ষোভেরই ফল।’’ যদিও অভিযোগ উড়িয়ে পঞ্চায়েত প্রধান শ্রাবণী দাস বলেন, ‘‘সমস্ত কাজ স্বাভাবিক ভাবেই চলছে। কাটমানি-বিক্ষোভের প্রভাব পড়েনি।’’
আউশগ্রাম ২ ব্লকের দেবশালা পঞ্চায়েতে আবাস যোজনায় প্রাপক বাছাইয়ে কাটমানি নেওয়ার অভিযোগে বিক্ষোভ হয়। তার পর থেকে পঞ্চায়েত কর্তৃপক্ষ আবাস যোজনার নাম নথিভুক্তির ব্যাপারে জন্য বেশ কিছু সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। চলতি অর্থবর্ষে আবাস যোজনার জন্য প্রায় ৪০০ জনের নাম ব্লক অফিসে পাঠানো হয়েছে। প্রধান শ্যামল বক্সী জানান, যে উপভোক্তার নাম নথিভুক্ত হবে, তাঁকে খবর দেওয়া হচ্ছে। পরে সব নথি নিয়ে ওই উপভোক্তা পঞ্চায়েত কার্যালয়ে এলে, তাঁর সব নথি পঞ্চায়েত সদস্যেরা পরীক্ষা করে দেখার পরে, সংশ্লিষ্ট সব পক্ষকে দিয়ে সই করিয়ে নথি জমা নেওয়া হচ্ছে।
পঞ্চায়েত সূত্রে জানা গিয়েছে, আগে উপভোক্তার নাম নথিভুক্তিকরণে এত নির্দিষ্ট নিয়ম ছিল না। ‘সময়সাপেক্ষ’ এই নতুন পদ্ধতি চালুর কারণ কী? প্রধানের জবাব, ‘‘দুর্নীতি এড়াতে এই ব্যবস্থা।’’ ‘কাটমানি’ নেওয়ার অভিযোগ এড়াতে হাওড়ার আমতার রসপুর পঞ্চায়েতে ‘বিশেষ তৎপরতা’ শুরু হয়েছে বলে দাবি তৃণমূলের স্থানীয় নেতাদের।
তবে ‘কাটমানি’ নেওয়ার অভিযোগ ওঠা পুরোপুরি বন্ধ হয়নি। পূর্ব মেদিনীপুরের তমলুক, হুগলির আরামবাগ মহকুমা তেমনই কিছু জায়গা। মুর্শিদাবাদের জেলা পরিষদ জুলাইয়ের শেষ সপ্তাহে ‘কাটমানি’ নিয়ে অভিযোগপত্র চেয়ে বিশেষ ‘সেল’ খুলেছে। সেখানে শ’খানেক অভিযোগ জমা পড়েছে। কিন্তু এক মাস পরেও একটি ক্ষেত্রেও ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি বলে অভিযোগ। পরিষদের তরফে ব্যাখ্যা, তদন্ত
শেষ হয়নি।
রাজ্য প্রশাসনের একাধিক কর্তা অবশ্য মনে করেন, মুখ্যমন্ত্রী ‘কাটমানি’র বিরুদ্ধে মুখ খোলায় এবং ‘দিদিকে বলো’ কর্মসূচি চালু হওয়ায়, অনেকে ভয়ে রয়েছেন। তাই হয়তো কিছু কাজে দেরি হচ্ছে। তাঁদের দাবি, ‘‘এখন নানা স্তরে স্বচ্ছতা বাড়ছে। পদাধিকারীদের কাজ করার স্পৃহাও বাড়ছে। তাঁদের অনেকেরই মনে হচ্ছে, কাজ না করলে প্রচার হয়ে যাবে যে কাটমানি না পাওয়ায় তাঁরা কাজ করছেন না।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy