পাশ দিয়ে যাচ্ছে সংশোধিত ওয়াকফ আইনের বিরুদ্ধে মিছিল। সে দিকে নজর ছিল না গাজলের বছর তিরিশের সংখ্যালঘু মহিলার। কোলে তাঁর দু’বছরের ছেলে, পাশে বৃদ্ধা মা। দীর্ঘক্ষণ দাঁড়িয়ে মালদহের প্রশাসনিক ভবনের সামনে। কেন? জবাব এল, “নামে ভুল থাকায় লক্ষ্মীর ভান্ডারের টাকা অ্যাকাউন্টে ঢুকছে না। মাসে ওই টাকাটা পেলে অনেক সুবিধে।”
সম্প্রতি গোষ্ঠী সংঘর্ষে তেতে উঠেছিল মালদহের মোথাবাড়ি। ওয়াকফ আইনের বিরোধিতায় লাগোয়া জেলা মুর্শিদাবাদে যে অশান্তি হয়েছে, তাতে ‘ভাত নয়, জাতের লড়াই’-এর বার্তা দিয়েছে বিজেপি। জানেন সে সব? মহিলা বলেন, “অতশত জানি না। এটুকু জানি, আমাদের সংসার চালাতে লক্ষ্মীর ভান্ডারের দরকার আছে।”
‘লক্ষ্মীর ভান্ডার’ প্রকল্পে অর্থনৈতিক ভাবে পিছিয়ে পড়া অংশের ২৫-৬০ বছরের মহিলাদের মাসে হাজার টাকা, তফসিলি জাতি, জনজাতিভুক্ত এবং অন্যান্য অনগ্রসর শ্রেণির মহিলাদের মাসে ১২০০ টাকা করে দেওয়া হয়। শুধু মুর্শিদাবাদ বা মালদহ নয়, দক্ষিণ ২৪ পরগনার ভাঙড়ের ভুমরু গ্রামের সালেমা বিবি, হুগলির খানাকুলের কুলাট গ্রামের সোমা জানা, বর্ধমানের পীরবাহারামের নাফিসা বিবি, পশ্চিম মেদিনীপুরের কেশপুরের গৃহবধূ ঝুমা গায়েনরা বলছেন, দু’-একটি জেলায় গোষ্ঠী সংঘর্ষ তাঁদের চিন্তায় ফেলেছে ঠিকই। তবে তাঁরা বেশি উদ্বিগ্ন আনাজপাতি, নিত্যপণ্য, গ্যাসের দাম বেড়ে যাওয়ায়। তাই সংসার চালাতে ভাতার টাকা তাঁদের ‘মুশকিল আসান’।
নদিয়ার কৃষ্ণনগরের বাসিন্দা, পরিচারিকা সফিনা বিবির সংসার মেয়ে আর নাতিকে নিয়ে। সফিনার উপলব্ধি, “অন্য কিছু নিয়ে ভাবার উপায় নেই। মা-মেয়ে ভাতার টাকা না পেলে, না খেয়ে থাকতে হত।” হাওড়ার পাঁচলার রেশমা বেগম বলেন, “স্বামীর রোজগার অল্প। চাই, ছেলে ইংরেজি মাধ্যম স্কুলে পড়ুক। ভাতার টাকায় তা হচ্ছে।” পাঁচলার ওই সংখ্যালঘু প্রধান এলাকায় একটি ইংরেজি মাধ্যম স্কুলে গত কয়েক বছরে পড়ুয়ার সংখ্যা বেড়েছে ‘লক্ষ্মীর ভান্ডার’-এর প্রাপকদের দৌলতে। হাওড়ায় স্বনির্ভর গোষ্ঠীর সদস্যেরা গোষ্ঠী-ঋণের কিস্তি মেটাচ্ছেন প্রকল্পের টাকায়।
জলপাইগুড়ির ধূপগুড়ির এক গ্রামে পাশাপাশি বাড়ি হিন্দু এবং মুসলিম পরিবারের। হিন্দু বধূর কথায়, “শুনেছি, জাত নিয়ে গোলমালে অনেকে বাড়িছাড়া। তবে গোলমাল দু’দিনে থেমে যায়। ভাতার টাকা বন্ধ হলে সমস্যা।” পাশের বাড়ির সংখ্যালঘু বধূ বলেন, “ভাতার টাকায় ছেলেকে ইদের পোশাক দিয়েছি। ওয়াকফ আন্দোলনে কী হচ্ছে জানি না।” ওয়াকফ আন্দোলন নিয়ে একই রকম কথা শোনা গিয়েছে, কোচবিহার, আলিপুরদুয়ার, দুই দিনাজপুরের সংখ্যালঘু মহিলাদের মধ্যেও।
“খবরে শুনছি, ওয়াকফ নিয়ে সংঘর্ষের কথা। কিন্তু আমাদের এলাকায় সমস্যা হয়নি,” বলছিলেন বীরভূমের দুবরাজপুরের এক মহিলা স্বনির্ভর দলের সদস্য। ‘লক্ষ্মীর ভান্ডার’ দেয় বলেই কি তৃণমূল সরকারের সমালোচনা করছেন না? মহিলার জবাব, “আরও অনেক কিছু এই সরকার মেয়েদের জন্য করেছে।” সংশোধিত ওয়াকফ আইনের প্রতিবাদ নিয়ে দীর্ঘদিন তেতে থাকা জেলা মুর্শিদাবাদের হরিহরপাড়াতেই জেসমিনা বেওয়া বলেন, “রেশনের চাল এবং লক্ষ্মীর ভান্ডারের টাকায় সংসার চলে। সেখানে কোথায়, কী গন্ডগোল হল, দেখার সময় কোথায়?”
তা বলে সবাই উচ্ছ্বসিত নন। মালদহের পুখুরিয়ার চৌদুয়ার বাসিন্দা মৃত পরিযায়ী শ্রমিক সেনাউল হকের স্ত্রী মিলি বিবি বলেন, “সরকার ভাতা দিচ্ছে। কিন্তু সে টাকায় সংসার চলে না বলেই কাজের খোঁজে আমাদের মতো পরিবারের ছেলেদের ভিন্ রাজ্যে ছুটতে হয়। মিজোরামে সেতু ভেঙে স্বামী মারা যান। জেলায় কাজ থাকলে তাঁকে বাইরে যেতে হত না!” পশ্চিম মেদিনীপুরের চন্দ্রকোনা রোডের নয়াবসত এলাকার গৃহবধূ সুপর্ণা ঘোষ ‘লক্ষ্মীর ভান্ডার’-এর ভাতা পান। চাষি পরিবারে আসে ‘কৃষকবন্ধু’র ভাতাও। তিনি বলছেন, “ছেলেমেয়েদের চাকরি জুটছে না। একশো দিনের কাজ বন্ধ। জমির ফসলের ন্যায্য দাম মেলে না। বাধ্য হয়ে সরকারি ভাতার উপরে নির্ভর করতে হয়।’’
বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির প্রাক্তন অধ্যাপক অরূপ চট্টোপাধ্যায় বলেন, “যেখানে ধর্মের জিগির উঠবে, সেখানে সবই পিছনে চলে যায়। কিন্তু যেখানে ধর্ম নিয়ে মাতামাতি কম, সে জায়গায় লক্ষ্মীর ভান্ডার গুরুত্বপূর্ণ। ভাতার সামান্য টাকাও মহিলারা নিজেদের আয় মনে করেন। সেটা কেউ ছাড়তে চান না।” তবে অর্থনীতিবিদ তথা বালুরঘাটের বিজেপি বিধায়ক অশোক লাহিড়ীর ব্যাখ্যা, “রাজ্যে ব্যবসার অনুকূল পরিবেশ না থাকলে, কেবল অনুদানের টাকায় মহিলারা সাবলম্বী হন, খুব একটা শোনা যায়নি। যেটুকু ঋণ নেওয়া বা কিস্তি শোধ চলছে, তা শান্তিপূর্ণ পরিবেশেই সম্ভব।” তাঁর সংযোজন: “রাজ্যে যে ভাবে সাম্প্রদায়িক অশান্তি বাড়ছে, তাতে অস্তিত্বের সঙ্কট দেখা দিলে কোনও ভান্ডার দিয়েই কিছু করা সম্ভব নয়।”
( চলবে)
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)