পুলিশের দিকে ইটের টুকরো ছুড়ছে দুষ্কৃতীরা। বুধবার গভীর রাতে, আরজি কর হাসপাতালের সামনে। ছবি: সুদীপ্ত ভৌমিক।
পুলিশের কাছে কেন আগাম খবর ছিল না? পুলিশের ‘ইন্টেলিজেন্স’ কেন চূড়ান্ত ব্যর্থ হল? কেন আরও দ্রুত ঘটনাস্থলে বাহিনী পাঠিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনা গেল না? আরজি কর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে হামলার ঘটনায় এমনই প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে। সেই সঙ্গেই প্রশ্ন উঠেছে, পুলিশ কি সত্যিই এত অসহায় ছিল, যে প্রত্যক্ষদর্শী নার্সদের দাবি অনুযায়ী, পোশাক বদলে পালানোর চেষ্টা করেছিলেন কেউ কেউ? না কি পুলিশের সামনেই অবলীলায় দুষ্কৃতীদের তাণ্ডব চলার পিছনে রয়েছে অন্য কোনও রহস্য।
এই ঘটনা প্রসঙ্গে দিনভর কলকাতা পুলিশের তরফে প্রকাশ্যে মন্তব্য করা হয়নি। কলকাতা পুলিশের এক শীর্ষ কর্তা নার্সদের এই দাবি প্রসঙ্গে বলেন, ‘‘ওই সময়ে কে কী করেছেন, সব দেখা হবে। যদি এমন হয়ে থাকে, তা হলে বুঝতে হবে অত্যন্ত খারাপ পরিস্থিতি তৈরি করা হয়েছিল পুলিশের জন্য।’’
পুলিশ সূত্রে জানা গিয়েছে, হাসপাতালে হামলার ঘটনায় স্বতঃপ্রণোদিত মামলা করা হয়েছে। এক মহিলা-সহ ১০ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। বৃহস্পতিবার শিয়ালদহ আদালতে তাদের তোলা হলে ২২ অগস্ট পর্যন্ত পুলিশ হেফাজত দেওয়া হয়। তবে তারা কারা, তা নিয়ে পুলিশ প্রকাশ্যে কিছু জানায়নি।
আরজি কর মেডিক্যাল কলেজে এক চিকিৎসককে খুন ও ধর্ষণের ঘটনার প্রতিবাদে স্বাধীনতা দিবসের আগের রাতে, বুধবার কার্যত গোটা বাংলা রাস্তায় নেমে আসে। জায়গায় জায়গায় শান্তিপূর্ণ অবস্থান বিক্ষোভ হয়। তার মধ্যেই আরজি কর হাসপাতালের সামনে দিয়ে একটি মিছিল বেরিয়ে যাওয়ার পর জনা চল্লিশেক লোক হাসপাতালের ভিতরে ঢুকে পড়ে। তার পর জরুরি বিভাগের এক তলা থেকে তিন তলা পর্যন্ত ভাঙচুর চালায় তারা।
বুধবার রাতে ও বৃহস্পতিবার সকালে ঘটনাস্থলে গিয়ে দেখা যায়, হাসপাতালের গেট পেরিয়ে ডান দিকে পুলিশ ছাউনি বলে কিছুই অবশিষ্ট নেই। চিকিৎসকদের সভামঞ্চ গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। বাঁ দিকে আপৎকালীন বিভাগে একের পর এক ওয়ার্ড ভাঙা হয়েছে। গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়েছে ভেন্টিলেশন যন্ত্র। ভাঙা হয়েছে সিসি ক্যামেরা। পুলিশ যে ঘরে থাকে সেখানে মাটিতে পড়ে রয়েছে পুলিশের ছেঁড়া উর্দি, পুলিশের জুতো। পুলিশের সিল করে দেওয়া দরজার তালা ভেঙে ঢোকা হয়েছে ভিতরে। কোনও মতে রক্ষা পেয়েছে চারতলার ঘটনাস্থল সেমিনার রুম। চিকিৎসকদের দাবি, আসলে সেমিনার রুমেই যেতে চেয়েছিল ওই দুষ্কৃতীরা। কিন্তু সেটি চার তলায় না তিন তলায়, তা-ই গুলিয়ে ফেলে হয়তো তারা আর কিছু করতে পারেনি।
কিন্তু এমন তাণ্ডব কী করে পুলিশবাহিনীর সামনে ঘটল? পুলিশ কেন কার্যত দর্শকের ভূমিকা পালন করল? এর পিছনে অন্য কোনও রাজনীতি নেই তো? দিনভর এই প্রশ্নই ঘুরপাক খাচ্ছে নানা মহলে।
এই প্রশ্ন আরও জোরালো হয়েছে, পুলিশের ভূমিকায়। এ দিন সকালে সমাজমাধ্যমে কলকাতা পুলিশের তরফে একটি পোস্ট করা হয়। তাতে হাসপাতালে হামলা চালানোর ঘটনার কয়েকটি ছবি দিয়ে বেশ কয়েক জনের মুখ পুলিশ চিহ্নিত করে দেয়। সঙ্গে লেখা হয়, ‘সন্ধান চাই: নীচের ছবিতে যাদের চেহারা চিহ্নিত করা হয়েছে, তাদের সন্ধান জানা থাকলে অনুরোধ, জানান আমাদের, সরাসরি বা আপনার সংশ্লিষ্ট থানার মাধ্যমে।' প্রত্যক্ষদর্শীদের দাবি, অন্তত জনা ষাটেককে চিহ্নিত করা ওই ছবি-সহ পোস্টেই পুলিশ প্রথমে লিখেছিল, হামলাকারীদের হাতে একটি বিশেষ রাজনৈতিক দলের পতাকা দেখা গিয়েছে। কিছু ক্ষণের মধ্যেই সেই পোস্ট বদলে ফেলে পুলিশ। রাজনৈতিক দলের পতাকার বিষয়টি বাদ দিয়ে দেওয়া হয়। কী কারণে পুলিশ বয়ান বদল করল? সাধারণ নাগরিকদের অনেকেই সেই পোস্টে প্রতিক্রিয়া দিয়েছেন, ‘একে তো এমন ঘটনা যে ঘটবে, পুলিশ জানতেই পারেনি। তাদের ইন্টেলিজেন্স কাজ করেনি। এখন সমাজমাধ্যমে ছবি দিয়ে পরিচয় জানাতে বলা হচ্ছে? সাধারণ মানুষই যদি সব করবে, পুলিশ করবে কী?’ এক জন লিখেছেন, ‘আসলে এরা সব প্রভাবশালীর লোক। সমাজমাধ্যমে ছবি দিয়ে দায় সারা হয়েছে। সাধারণ মানুষ ধরে দিলে পুলিশের আর দায় থাকে না।’
সমাজমাধ্যমে আর একটি পোস্টে কলকাতা পুলিশের তরফে আরজি কর হাসপাতালে হামলার ঘটনায় আক্রান্ত পুলিশকর্মীদের ছবি তুলে ধরা হয়েছে। সঙ্গে লেখা হয়েছে, ‘পাঁচ থেকে সাত হাজার জনের’ একটি বাহিনী হাসপাতালে ঢুকে হামলা চালিয়েছে। অনেক কম লোক নিয়ে পরিস্থিতি সামলানোর চেষ্টা করা পুলিশকর্মীদের জন্য গর্বিত লালবাজার। অনেকেই লিখেছেন, ‘সাধারণ মানুষ, চিকিৎসক, হাসপাতাল কর্মী, রোগীর আত্মীয়েরা আক্রান্ত হয়েছেন। সেখানে কয়েক জন পুলিশকর্মীর আহত হওয়ার ছবি দিয়ে কেন প্রচার চালানোর চেষ্টা হচ্ছে?’
ওই তাণ্ডবের সময়ে কয়েক জন পুলিশকর্মী শৌচাগারে লুকিয়েছিলেন বলে দাবি করেছেন নার্সদের একাংশ। বুধবার রাতে এসএনসিইউ-তে কর্তব্যরত নার্সদের দাবি, এক দল পুলিশকর্মী ভিতরে এসে শৌচাগারের ভিতরে লুকিয়ে পড়েন। মহিলা পুলিশকর্মীরা নার্সদের থেকে সাধারণ পোশাক চেয়ে সেগুলো পরে লুকোতে চান। ওই নার্সদের অভিযোগ, পুলিশকর্মীরা তাঁদের বলেন, ‘আপনারা নিজেদের নিরাপত্তার ব্যবস্থা নিজেরা করে নিন। আমাদেরও বাড়িতে পরিবার আছে।’ এই অভিযোগও উঠেছে যে, হাসপাতাল চত্বরে থাকা পুলিশের গাড়িতে যাঁরা ছিলেন, তাঁরা ট্রমা কেয়ারে গিয়ে আশ্রয় নেন। এই প্রসঙ্গে কলকাতা পুলিশের এক শীর্ষ কর্তা জানান, ওই সময়ে কে কী করেছেন, তা দেখা হবে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy