Advertisement
২০ ডিসেম্বর ২০২৪
Quack Doctor

মৃত্যুর দেদার শংসাপত্র গ্রামীণ ‘হাতুড়ের’ হাতে

অতীতে এঁরাই খোলামেলা ভাবে গ্রামে সমস্ত ধরনের চিকিৎসা করতেন এবং মৃত্যুর শংসাপত্রও দিতেন বলে সরাকরি সূত্রের খবর। কিন্তু, বর্তমানে রাজ্য সরকার এ বিষয়ে যথেষ্ট কড়া মনোভাব নিয়েছে।

representational image

—প্রতীকী ছবি।

পরিজাত বন্দ্যোপাধ্যায়
কলকাতা শেষ আপডেট: ২১ অগস্ট ২০২৩ ০৭:৩০
Share: Save:

একেই কি বলে বজ্র আঁটুনি, ফস্কা গেরো।

এক দিকে গ্রামীণ চিকিৎসকদের (যাঁদের এককালে হাতুড়ে ডাক্তার বলা হত) গ্রামেগঞ্জে ‘ডাক্তারি’ করা থেকে বিরত রাখতে কড়া মনোভাব নিয়েছে রাজ্য সরকার। অন্য দিকে, ডাক্তারের অভাবে বিভিন্ন জেলার প্রত্যন্ত এলাকায় স্থানীয় মানুষ, প্রশাসন, পঞ্চায়েত, রাজনৈতিক নেতা, ধর্মীয় নেতাদের চাপে এই গ্রামীণ চিকিৎসকেরা মৃতের ‘ডেথ সার্টিফিকেট’ বা মৃত্যুর শংসাপত্র লিখতে বাধ্য হচ্ছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। অতীতে এঁরাই খোলামেলা ভাবে গ্রামে সমস্ত ধরনের চিকিৎসা করতেন এবং মৃত্যুর শংসাপত্রও দিতেন বলে সরাকরি সূত্রের খবর। কিন্তু, বর্তমানে রাজ্য সরকার এ বিষয়ে যথেষ্ট কড়া মনোভাব নিয়েছে। তাঁরা কতটুকু চিকিৎসা করতে পারবেন, সে বিষয়ে নির্দিষ্ট নিয়মও লিখিত ভাবে জানিয়ে দেওয়া হয়েছে। তার পরেও একাধিক পঞ্চায়েত এলাকায় এই গ্রামীণ চিকিৎসকেরা মৃত্যুর শংসাপত্র দিচ্ছেন বলে অভিযোগ উঠেছে।

রাজ্যে গ্রামীণ চিকিৎসকদের সবচেয়ে বড় সংগঠন ‘পল্লিচিকিৎসক সংগঠন’ এ ব্যাপারে একাধিক বার স্বাস্থ্যভবনের কর্তাদের সঙ্গে দেখা করে তাঁদের সমস্যার কথা জানিয়েছেন। কিন্তু সমাধানের রাস্তা কেউ বাতলাতে পারেননি বলে তাঁদের অভিযোগ। সংগঠনের রাজ্য কমিটির সম্পাদক অরুণকান্তি ঘোষের কথায়, ‘‘সরকার আমাদের চিকিৎসা করতে বারণ করছে। ওষুধ রাখলে বা রোগীকে ওষুধ দিলে ড্রাগ কন্ট্রোল এসে ধরছে। অথচ, গ্রামে আমরা ওষুধ না লিখলে সেখানকার স্থানীয় মানুষ, রাজনৈতিক নেতারা আমাদের উপর চড়াও হচ্ছেন। কারণ, সেখানে আমরাই সম্বল। সরকার সেখানে পাশ করা ডাক্তার পাঠাতে পারছে না। গ্রামে চাপের মুখে আমরা ডেথ সার্টিফিকেট লিখতে বাধ্য হচ্ছি, কিন্তু ধরা পড়লে কেউ পাশে থাকছে না। আমাদের জলে কুমীর, ডাঙায় বাঘ।’’

গ্রামীণ চিকিৎসকদের দেওয়া শংসাপত্রের ভিত্তিতে মৃতের সৎকারও হয়ে যাচ্ছে বলে অভিযোগ উঠেছে। পশ্চিম মেদিনীপুরের সাঁতোরিয়া এলাকায় হৃদ্‌রোগে আক্রান্ত হয়ে এক রোগী বাড়িতে মারা গিয়েছেন বলে এক গ্রামীণ চিকিৎসক শংসাপত্র দিয়েছেন চলতি বছর ২৫ ফেব্রুয়ারি। উত্তর ২৪ পরগনার আমডাঙা এলাকায় এক চিকিৎসক মৃত্যুর শংসাপত্র লিখেছেন গত ১৪ এপ্রিল। দক্ষিণ দিনাজপুরের গঙ্গারামপুরের এক গ্রামীণ চিকিৎসক এক জনের মৃত্যুর শংসাপত্র দিয়েছেন গত বছর ১ সেপ্টেম্বর। এই রকম অসংখ্য উদাহরণ রয়েছে বলে দাবি।

এ ব্যাপারে রাজ্যের স্বাস্থ্য অধিকর্তা সিদ্ধার্থ নিয়োগীর কাছে জানতে চাওয়া হলে তিনি ‘মিটিংয়ে ব্যাস্ত আছি’ বলে এড়িয়ে গিয়েছেন। গ্রামীণ চিকিৎসকদের সংগঠনের রাজ্য সভাপতি দিলীপ কুমার পানের কথায়, ‘‘স্বাস্থ্যকর্তাদের কিছু বলার মুখ নেই।’’ অরুণকান্তি, দিলীপ কুমারেরা জানান, বছর দু’য়েক আগে পর্যন্ত বিভিন্ন পঞ্চায়েত লিখিত ভাবেই এলাকার গ্রামীণ চিকিৎসকদের মৃত্যুর শংসাপত্র দিতে বলত। কিন্তু কয়েকটি জায়গায় সমস্যা হওয়ায় লিখিত দেওয়া বন্ধ হয়েছে। এখন সব মুখেমুখে হয়।

বহু গ্রামে ৪-৫ কিলোমিটারের মধ্যে ব্লক প্রাথমিক স্বাস্থ্য কেন্দ্রটুকু নেই। স্থানীয় মানুষ অসুস্থ হলে গ্রামীণ চিকিৎসকদের কাছেই দেখান। প্রশ্ন উঠেছে, তাঁদের মধ্যে কেউ বাড়িতে মারা গেলে মৃত্যুর শংসাপত্র কে দেবে? রোগীর বাড়ির লোক তখন গ্রামীণ চিকিৎসকেরই দ্বারস্থ হন। দিলীপ বলেন, ‘‘প্রশিক্ষিত ডাক্তারের অভাবে অনেক জায়গায় বিডিওরা মৌখিক ভাবে গ্রামীণ চিকিৎসককে সার্টিফিকেট লিখে দিতে বলেন। পঞ্চায়েতও বলে। তাতেও আমরা রাজি না হলে তখন রাজনৈতিক নেতাদের দিয়ে চাপ দেওয়া হয়। তখন ভয়ে সার্টিফিকেট লিখে দিতে হয়। গ্রামে তো আমাদের থাকতে হবে! অনেক সময় স্থানীয় ধর্মীয় নেতারা ‘অমুক লোক বাড়িতে অসুস্থ হয়ে মারা গিয়েছেন’ বলে একটি লিখিত বয়ান দেন। তার ভিত্তিতে গ্রামীণ চিকিৎসক ডেথ সার্টিফিকেট লিখে দেন।’’

মৃত্যুর শংসাপত্র দিতে গেলে চিকিৎসককে তাঁর রেজিস্ট্রেশন নম্বর দিতে হয়। গ্রামীণ চিকিৎসকেরা অধিকাংশই বিভিন্ন বেসরকারি কেন্দ্র থেকে প্রাথমিক প্রশিক্ষণ, ডিপ্লোমা বা সার্টিফিকেট জোগাড় করেন। সেখানে একটা নম্বর দেওয়া থাকে। সেটাই রেজিস্ট্রেশন নম্বরের জায়গায় লেখা হয়। দিলীপ কুমারের কথায়, ‘‘মুখ্যমন্ত্রী তো ডিপ্লোমা ডাক্তার তৈরি করে গ্রামে পাঠাতে চেয়েছিলেন। তার জন্য কমিটিও হল। কিন্তু সে সব তো ভেস্তে গেল। আমরাই গ্রামের ভরসা থেকে গেলাম। যাবতীয় কাজ গ্রামে আমরাই করছি, কিন্তু সরকার স্বীকৃতি দিচ্ছে না।’’

অন্য বিষয়গুলি:

Quack Doctor death certificate
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy