ঘটনা: ১
ইদানিং শহরের বিভিন্ন এলাকা থেকে সাইকেল ও মোটরবাইক চুরির ঘটনায় দিশেহারা পুলিশ। একটি চুরির তদন্তে নেমে পুলিশ কর্তাদের চক্ষু চড়কগাছ। অভিজাত এলাকার এক প্রতিষ্ঠিত পরিবারের এক মেধাবি ছাত্রকে সাইকেল তুলে নিয়ে যেতে দেখা যায় পাশের দোকানের সিসিটিভি ফুটেজে! জিজ্ঞাসাবাদে পুলিশ জানতে পারে, নেশার সামগ্রী কেনার জন্যই সে এমন কাজ করেছে। একই কারণে সে প্রায় দিন বাবার পকেট থেকেও টাকা চুরি করত।
ঘটনা: ২
শহরের শুঁড়িপাড়া এলাকায় কয়েক মাস দুই যুবকের অস্বাভাবিক মৃত্যু হয়। পরিবার এবং স্থানীয় বাসিন্দাদের দাবি, নেশায় আসক্ত হয়ে পড়েছিলেন ওই দুই যুবক। নেশা করার টাকা না পাওয়ায় ৪৮ ঘণ্টার ব্যবধানে দু’জনই আত্মহত্যার পথ বেছে নেন বলে পরিবারের দাবি। ওই ঘটনার পরেই এলাকার বেশ কিছু নেশার ঠেক, মাদক বিক্রির স্থান এবং বিক্রেতাদের বাড়িতে চড়াও হন স্থানীয় বাসিন্দারা। তাঁদের অভিযোগ, ওই বিক্রেতারাই যুব প্রজন্মের হাতে তুলে দিচ্ছেন মারণ নেশার দ্রব্য।
বোলপুর শহরের এই দুই উদাহরণ কোনও বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। সন্ধে নামলেই শহরের বিভিন্ন স্থানে নেশার ঠেক বসছে। আর নিত্য-নতুন গজিয়ে ওঠা ওই সব ঠেকেই শহরের স্কুল-কলেজ, বিশ্বভারতীর পড়ুয়া থেকে এলাকার বেকার যুবদের একাংশকে নেশা করতে দেখা যাচ্ছে। পুলিশের দাবি, এন-১০, কোরেক্স, ব্রাউনসুগার নেওয়ার সময়ে বেশ কিছু ছাত্রছাত্রীকে এলাকা থেকে ধরাও হয়েছে। এই পরিস্থিতিতে শান্তিনিকেতন লাগোয়া শহরের বেশ কয়েকটি রাস্তায় কয়েক ফুট দূরত্বের ব্যবধানে কীভাবে পরপর মদের দোকানের লাইসেন্স পেল, বাসিন্দারা তা নিয়ে প্রশ্ন তুলতে শুরু করেছেন। ওই সব দোকানের সামনে এবং সব ক’টি ধাবায় মাতালদের গণ্ডগোল কার্যত রোজকার ঘটনা হয়ে উঠেছে বোলপুরে। বাসিন্দাদের অভিযোগ, নেশা রুখতে পুলিশের দিক থেকে কোনও কড়া পদক্ষেপ দেখা যায় না। মাঝে মধ্যে ধরপাকড় চললেও পুরোপুরি বন্ধ করা যাচ্ছে না নেশার কারবার। আবার এ নিয়ে এলাকায় সচেতনতা বৃদ্ধি করার ক্ষেত্রেও প্রশাসন তেমন উদ্যোগ নেয় না বলেই বাসিন্দাদের ক্ষোভ।
পুলিশ ও স্থানীয় সূত্রে খবর, বোলপুর স্টেশন এলাকায় পথশিশুদের প্লাস্টিকের মধ্যে মুখ গুঁজে নেশা করা বা ডাকবাংলো মাঠের স্টেডিয়ামের পিছন, পূর্বপল্লির রাস্তায় স্কুলছুটদের বিড়ি, সিগারেট, মদ, গাঁজার নেশা নতুন নয়। এর বাইরেও নানা ধরনের নেশাজাত দ্রব্যে আসক্ত হয়ে উঠছে শহরের নবীন প্রজন্ম। লাল চায়ের সঙ্গে এক ধরনের কাসির সিরাপ মিশিয়ে খাওয়ার চল বাড়ছে। সঙ্গে নেশার ইঞ্জেকশন নেওয়া বা বিশেষ এক ধরনের আঠাকে প্লাস্টিকের মধ্যে দিয়ে শুঁকে নেশা করার প্রবণতাও বাড়ছে। বোলপুর থানার এক পুলিশ অফিসারের কথায়, “শহরের যুব সম্প্রদায় এখন সব থেকে বেশি ব্রাউনসুগারের নেশায় ভুগছে। স্থানীয়রা যাকে ‘পাতা’ বলে ডাকেন। কখনও সিগারটের সঙ্গে নেওয়া হয়, আবার কখনও শুধু কাগজেই কাজ চালিয়ে নেওয়া হয়।” তিনি মেনে নিচ্ছেন, শান্তিনিকেতনের মেলারমাঠ, দিগন্তপল্লি, ইন্দিরা গাঁধী কেন্দ্র লাগোয়া মাঠ, সেবাপল্লি এলাকার একটি দোকান ও রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কের পিছনে, অরশ্রি মার্কেট এলাকায় বড় বড় নেশার ঠেক রয়েছে। এমনকী, ওই পুলিশ অফিসারের দাবি, ওই সব নেশার ঠেক থেকে জিনিস পৌঁছে যায় বিশ্বভারতীর বিভিন্ন হস্টেলের একাংশের পড়ুয়ার কাছেও। নেশার ঠেকে একাধিক বার পুলিশ অভিযান চালিয়ে কয়েক জনকে হাতেনাতে ধরেছে।
মাসখানেক আগে আবার নামকরা কয়েকটি দোকান ছাড়া বোলপুরের অধিকাংশ চায়ের দোকানে লাল চা বিক্রির উপর অলিখিত নিষেধাজ্ঞা জারি করেছিল পুলিশ। পুলিশের একটি সূত্রের দাবি, নেশা রুখতেই এই পদক্ষেপ করা হয়েছিল। খবর ছিল, শহরের সিয়ান হাসপাতাল মোড়, বোলপুর হাইস্কুল মোড়, জামবুনি মোড়, হাটতলা মোড়, বাইপাস মোড় এলাকায় রমরমিয়ে নেশার কারবার জমে উঠছিল। এক পুলিশ কর্মী বলছেন, “ছোট বড় অনেকে এই ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত হলেও হাটতলার বাসিন্দা ভুটন শেখ, ভুবনডাঙার এক চা দোকানি, স্কুলবাগানের বাপ্পা হাজরা, শুঁড়িপাড়ার কদম সাহানি, বুড়ি সাহানি (এলাকার দাগী দুষ্কৃতী মঙ্গল সাহানির আত্মীয়), লায়েকবাজার এলাকার নুরজাহান বিবিরা বিভিন্ন ভাবে এই নেশার এবং ড্রাগের কারবার সঙ্গে জড়িত থাকায় একাধিকবার গ্রেফতার করা হয়েছে।” এ ছাড়াও পুলিশের খাতায় লায়েকবাজার, মুলুক, সুকবাজার এবং শুঁড়িপাড়া, সুরুশ্রী পল্লি, ভুবনডাঙা, দূরদর্শন কেন্দ্র, দমকল কেন্দ্রের পিছনে, রেললাইনের ধার বরাবর এলাকা নেশা করার এবং নেশায় আসক্তদের ঠেক বলে চিহ্নিত। ওই সব এলাকায় প্রকাশ্য দিবালোকে অনেক যুবককে ড্রাগ ও ইঞ্জেকশন নিতে দেখা যায়। সেখান থেকে গত২৬ জুন ১২০ বোতল কাসির সিরাপ, ১৫০ স্ট্রিপ ইঞ্জেকশন এবং ৪০ স্ট্রিপ নিষিদ্ধ ড্রাগ-সহ স্থানীয় দুই যুবককে গ্রেফতার করেছিল পুলিশ।
এ দিকে, বোলপুর-শান্তিনিকেতন এলাকার এল্মহার্স্ট ইন্সটিটিউটের অন্তর্গত একটি নেশা বিমুক্তিকরণ এবং পুনর্বাসন কেন্দ্র রয়েছে। ওই কেন্দ্রের হিসেব অনুযায়ী, গত ১৪ বছরে এলাকার প্রায় আড়াই হাজার নেশাসক্ত ব্যক্তি ওই কেন্দ্রে ভর্তি হয়েছেন। যাঁদের মধ্যে যুবকদের সংখ্যাই বেশি। কেন্দ্রের প্রকল্প অধিকর্তা হাসনাথ মোল্লার পর্যবেক্ষণ, “গত তিন বছর ধরে বোলপুর এলাকায় ব্রাউন সুগারের বিক্রি অনেক বেড়ে গিয়েছে। বিশেষ করে শুঁড়িপাড়া এলাকায় ইদানিং কালে ব্রাউন সুগারের প্রভাব খুব মারাত্মক আকার ধারণ করেছে। ইঞ্জেকশন নেওয়ার প্রবণতাও খুব বেড়েছে। এলাকার যুব সম্প্রদায়ই বেশি করে নেশার কবলে পড়ছে।” সাম্প্রতিক কালে এলাকার বিভিন্ন স্কুলে ‘ড্রাগের নেশা সর্বনাশা’ বিষয়ক পড়ুয়াদের সচেতন কর্মসূচি নিয়েছে ওই কেন্দ্র। নেশায় আসক্তদের মানসিক অবস্থার ওপর নির্ভর করে তিরিশ দিনের বেসিক কোর্স করাচ্ছেন তাঁরা। কী বলছেন আসক্ত যুবরা?
বেশির ভাগই জানাচ্ছেন, নিছক কৌতূহল থেকেই একদিন নেশা করতে গিয়েছিলেন। কিন্তু এখন কোনও ভাবেই পরিত্রাণ মিলছে না।
এ ভাবেই নেশার অতলে হারিয়ে যাচ্ছে কি রবীন্দ্রনাথের বোলপুর-শান্তিনিকেতনের নবীন প্রজন্মের ভবিষৎ? উত্তর নেই কারও কাছেই!
ছবি: বিশ্বজিৎ রায়চৌধুরী।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy