জনস্রোতে ভাসলেন আসানসোলের বিজেপি সাংসদ বাবুল সুপ্রিয়। বোলপুরের ডাকবাংলো মাঠের সভা মঞ্চে যাওয়ার পথে। ছবি: বিশ্বজিৎ রায়চৌধুরী
শেষ পর্যন্ত অনুব্রত মণ্ডলের গলার ‘কাঁটা’ হয়েই রইল কসবা পঞ্চায়েত।
পঞ্চায়েত ভোটের পর থেকেই খবরের শিরোনামে থাকা কসবা পঞ্চায়েতে তৃণমূলকে কোনঠাসা হতে দেখা গিয়েছিল। এ দিন বোলপুরে বিজেপির আয়োজিত শহিদ শেখ রহিম মঞ্চে হাজির হয়ে, বিজেপিতে যোগ দিলেন কসবার প্রধান, উপপ্রধান-সহ ছয় সদস্য। তৃণমূলের জেলা সভাপতি অনুব্রত মণ্ডল এই পঞ্চায়েতের যে নির্দল প্রার্থীর বাবাকে খুনের দায়ে অভিযুক্ত, সেই হৃদয় ঘোষের হাতেও এ দিন বিজেপির রাজ্য সভাপতি রাহুল সিংহ দলীয় পতাকা তুলে দেন। জেলার রাজনৈতিক মহল মনে করছে, অনুব্রত-বিরোধী ঝড়েই নিজের গড়ে পঞ্চায়েত খোয়াল তৃণমূল। একইসঙ্গে জেলায় লোকসভা ভোটের পর এই প্রথম কোনও পঞ্চায়েত দখলে এল বিজেপির।
একসময় অনুব্রত ঘনিষ্ঠ বলে জেলায় তৃণমূলের পরিচিত মুখ ছিলেন কসবার নিমাই দাস। রাজনীতির পাশা উলটে কার্যত তাঁর নেতৃত্বেই পঞ্চায়েত নির্বাচনে কসবা পঞ্চায়েত নির্দল তথা বিক্ষুব্ধ তৃণমূলদের দখলে এসেছিল। প্রধান হন বিক্ষুব্ধ তৃণমূল নিমাইবাবুর স্ত্রী শঙ্করী দাস। উপপ্রধান হন তৃণমূলের প্রতীকে জেতা আর এক ‘বিক্ষুব্ধ’ পার্বতী বাগদী। সে সময়, দলের ক্ষমতাসীন গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে তৈরি হওয়া এই ‘বিক্ষোভে’র জেরেই পঞ্চায়েতে তৃণমূলের খারাপ ফল হয় বলে রাজনীতির কারবারিদের মত। নিমাই দাস এ দিন বলেন, “জেলাজুড়ে যে দুর্নীতি শুরু করেছে তৃণমূল, তাতে ও দলে থাকাটাই এখন সম্মানহানিকর। সাধারণ কর্মী-সমর্থকরাও দল ছাড়ছেন। শুধু কসবা নয়, ইলামবাজার, নানুর, লাভপুর, সাঁইথিয়া, রামপুরহাট, খয়রাশোল থেকেও মানুষ বিজেপিতে যোগ দিয়েছেন এ দিন।”
কার্যত কেন্দ্রে বিজেপি ক্ষমতায় আসার পরই জল্পনা বাড়ছিল, বিক্ষুব্ধ তৃণমূল কর্মী-সমর্থকদের বিজেপিতে যোগদান নিয়ে। এ দিনও নিমাইবাবুর নেতৃত্বেই তাঁরা বিজেপিতে যোগদান করেন। স্বাভাবিক ভাবেই, পূর্ব-নির্বাচনের মতোই অনুব্রত-বিরোধীরা বলতে শুরু করেছেন, জেলা সভাপতিরই নৈতিক পরাজয় হয়েছে। বিজেপিতে যোগ দিয়ে শঙ্করী দাস বলেন, “এলাকার উন্নয়ন ত্বরান্বিত করতে এবং বাসিন্দাদের কথা মাথায় রেখে আমরা বিজেপিতে যোগ দিয়েছি। বিজেপি একটি সুশৃঙ্খল দল।”
রাজ্যে পঞ্চায়েত নির্বাচনে বোলপুর ব্লকের কসবা পঞ্চায়েতে মোট ১২টি আসনের মধ্যে তৃণমূলের টিকিটে জয়ী হন ৭ জন। সাত তৃণমূল সদস্যর মধ্যে একজন সদস্য নির্দলদের সমর্থন করে। ফলে টাই হয়ে লটারির মাধ্যমে ওই পঞ্চায়েতের বোর্ড দখল করে বিক্ষুব্ধরা। গত লোকসভা নির্বাচনেও বোলপুর লোকসভা কেন্দ্রের বিজয়ী তৃণমূল প্রার্থী অনুপম হাজরার থেকে ওই পঞ্চায়েতে ২,৬৩৫টি ভোট বেশি পেয়েছিলেন সিপিএম প্রার্থী রামচন্দ্র ডোম। পঞ্চায়েতের ১৫টির মধ্যে ১৪টি গ্রাম সংসদেই পিছিয়ে পড়ে তৃণমূল। তৃণমূল পিছিয়ে যায় সে সময় সাগরবাবুর বাড়ি বাঁধ নবগ্রামেও। শুধু তা-ই নয়, সাগর ঘোষ খুনে অন্যতম অভিযুক্ত সাত্তোর অঞ্চলের সম্পাদক তথা পঞ্চায়েতে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জেতা শেখ মুস্তফা নিজের গ্রামেই প্রায় ৩০০ ভোটে পিছিয়ে পড়েন।
বিজেপির পতাকা হাতে হৃদয়-সহ কসবার বিক্ষুব্ধরা।—নিজস্ব চিত্র।
তৃণমূলের এই খারাপ ফল নিয়ে সিপিএমের জেলা সম্পাদক দিলীপ গঙ্গোপাধ্যায়ের তখন ব্যাখ্যা ছিল, “ওদের নিজেদের অন্তর্দ্বন্দ্বের কারণেই ফল তৃণমূলের বিপক্ষে গিয়েছে।” লোকসভা ভোটের প্রচারে কসবা পঞ্চায়েত এলাকায় বারবার পথসভা, জনসভা, মিছিল করেছে শাসক দল। একাধিক বার ঘুরে গিয়েছিলেন প্রার্থী থেকে তৃণমূলের জেলা নেতৃত্ব। কিন্তু তাতেও শেষ রক্ষা হয়নি। লোকসভা ভোটের ফলের হিসেবে দলেরই ‘বিক্ষুব্ধ’দের হাতে থাকা কসবা পঞ্চায়েতে সিপিএমের থেকে পিছিয়ে পড়েন অনুব্রত। হৃদয় ঘোষ বলেন, “যে ভাবে চারদিকে সন্ত্রাস চলছে, সেই সন্ত্রাসের প্রতিবাদে বিজেপিতে যোগ দিয়েছি। সাধারণ মানুষের পাশে থেকে ওই সন্ত্রাসের প্রতিবাদ করতে চাইছি। আশা করছি বিজেপি আমাদের পাশে থাকবে।”
এ দিন বোলপুর ডাকবাংলো মাঠে বিজেপির সভায় জেলার বিভিন্ন এলাকা থেকে বিক্ষুব্ধ তৃণমূল কর্মী-সমর্থকদের ভিড় ছিল চোখে পড়ার মতো। সাম্প্রতিক কালে জেলার যে সমস্ত এলাকায় তৃণমূল গোষ্ঠী কোঁদলে জড়িয়েছে, সেই কসবা, ইলামবাজার, নানুর, লাভপুর থেকে বহু বিক্ষুব্ধ তৃণমূল কর্মী-সমর্থক বিজেপিতে যোগদান করেন। রাজনীতির কারবারিদের বিশ্লেষণ, অনুব্রত মণ্ডলের বিরোধী গোষ্ঠীর প্রবল অসন্তোষ সুবিধা করে দিয়েছে বিজেপির। বীরভূমে দুটি পঞ্চায়েত বিজেপি পরিচালিত। জেলায় মোট ১৬৭টি পঞ্চায়েতের মধ্যে বিজেপির গ্রাম পঞ্চায়েতে সদস্য-সংখ্যা ৫৫। বিজেপির প্রধান রয়েছেন ময়ূরেশ্বর থানার কুণ্ডলা পঞ্চায়েত, ময়ূরেশ্বর পঞ্চায়েত এবং রামপুরহাট থানার নারায়ণপুর পঞ্চায়েতে। নারায়ণপুরে তৃণমূল জোট বিজেপি প্রধান রয়েছেন। জেলায় পঞ্চায়েত সমিতি ও জেলা পরিষদে বিজেপির কোনও সদস্য নেই। বিজেপি পরিচালিত পঞ্চায়েতের তালিকায় এবার যুক্ত হতে চলল কসবা পঞ্চায়েতের নাম। বোলপুরের বিডিও শমিক পানিগ্রাহী বলেন, “পঞ্চায়েত আইন অনুযায়ী যদি কেউ নো কনফিডেন্স প্রস্তাব আনে, সেক্ষেত্রে নিয়ম অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে। কিন্তু বর্তমান যে পরিস্থিতি আছে, তাতে স্ট্যাটাসকো বজায় থাকবে। এতে আমার কিছু বলার নেই।”
বিজেপির জেলা সভাপতি দুধকুমার মণ্ডল বলেন, “তৃণমূলের সন্ত্রাসের কারণে মানুষ বিজেপিতে আসছে। জেলার বহু মানুষ আনুষ্ঠানিকভাবে এ দিন দলে যোগ দিয়েছেন। তাঁদের মধ্যে রয়েছেন হৃদয় ঘোষ, কসবার প্রধান, উপপ্রধান সহ ছ’ সদস্য। গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে আমরা মানুষকে সঙ্গে নিয়ে সন্ত্রাসের প্রতিবাদ করছি।”
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy