এক-দু’ টাকা নয়, ৯৮ লক্ষ টাকার একটি কাজের চেক ভাঙাতে পুরপ্রধানেরই সই নকল করল রামপুরহাট পুরসভা!
যা ধরা পড়তে সঙ্গে সঙ্গেই সেই চেক আটকে দিয়েছে ট্রেজারি অফিস। গোটা ঘটনায় দুর্নীতির অভিযোগে আরও হাওয়া জুগিয়েছে খোদ পুরপ্রধানেরই পরস্পর বিরোধী দুই বক্তব্য। প্রথমে সংশ্লিষ্ট কাগজপত্রে থাকা স্বাক্ষরটিকে ভুয়ো বলেই দাবি করেছিলেন। কিন্তু, ঘটনার কথা জানাজানি হতে বয়ান বদলে কাগজে তাঁরই করা স্বাক্ষর না মেলার তত্ত্ব খাড়া করেছেন তৃণমূল পুরপ্রধান অশ্বিনী তিওয়ারি!
গোটা ঘটনায় তৃণমূল পুরসভার বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ তুলে সরব হয়েছে বিরোধীরা। ঘটনায় জড়িতদের বিরুদ্ধে আইনানুগ পদক্ষেপ করার দাবিও তাঁরা তুলেছেন। যদিও আশ্চর্যজনক ভাবে ৪৮ ঘণ্টা কেটে গেলেও ওই ঘটনায় পুর প্রশাসনের পক্ষ থেকে কোথাও কোনও অভিযোগ দায়ের হয়নি। আর তাতেই সই জালিয়াতির ঘটনায় খোদ তৃণমূল পরিচালিত ওই পুরসভার ভূমিকা নিয়ে শহরবাসীর সন্দেহ বেড়েছে।
ঠিক কী ঘটেছিল?
পুরসভা ও প্রশাসন সূত্রের খবর, গত বুধবার ৯৮ লক্ষ টাকার একটি রাস্তা সংস্কারের কাজের টাকা ঠিকাদারকে দিতে পুরসভা প্রয়োজনীয় কাগজপত্র-সহ চেকটি ‘প্রসেসিং’-এর জন্য মহকুমা ট্রেজারি অফিসে জমা দিয়েছিল। নিয়ম অনুযায়ী, পুরসভার হিসেবরক্ষক ওই সব কাগজে পুরপ্রধান এবং পুরসভার এগজিকিউটিভ আধিকারিকের সই করিয়ে তা এক পুরকর্মীকে দিয়ে ট্রেজারিতে ‘প্রসেসিং’য়ে পাঠান। ট্রেজারি অফিস ওই সব কাগজপত্র পরীক্ষা করে প্রয়োজনীয় কাজ করে তা পুরসভায় পাঠিয়ে দেয়। ‘প্রসেস’ হওয়া চেক এসে গেলে পুরসভা তা সংশ্লিষ্ট ঠিকাদারকে দিয়ে দেয়। ঠিকাদার ব্যাঙ্ক থেকে সেই চেক ভাঙিয়ে টাকা তোলেন। কিন্তু, সর্ষের মধ্যেই ভূত! রামপুরহাটের ঘটনায় ট্রেজারিতে জমা পড়া কাগজে পুরপ্রধানের সইটিই ছিল নকল। তাই ওই চেক ‘প্রসেস’ না করেই ট্রেজারি অফিস পুরসভাকে ফেরত পাঠিয়ে দেয়।
ওই ঘটনা নিয়ে সংবাদমাধ্যমকে কিছু জানাতে রাজি হননি ট্রেজারি অফিসার এস শ্রীবাস্তব। তবে, তিনি জানিয়েছেন, বিষয়টি মহকুমাশাসককে জানানো হয়েছে। এ দিকে, পুরসভার হিসেবরক্ষক সুভাষ হাজরার বক্তব্য, ‘‘ঠিকাদারের লোক ৪ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর আব্বাস হোসনকে নিয়ে আমার কাছে এসেছিলেন। তাঁরা পুরপ্রধানের কাছ থেকে সই করিয়ে আনবেন বলে কাজ শেষ হওয়ার সংশ্লিষ্ট কাগজটি আমার থেকে নিয়ে যান। পরে পুরপ্রধানের স্বাক্ষর আছে দেখে আমি চেকের সঙ্গে ওই কাগজ ট্রেজারিতে পাঠিয়ে দিই। যদিও ট্রেজারি অফিস থেকে জানায়, ওই সই পুরপ্রধানের নয়।’’ ঘটনার কথা জানাজানি হওয়ার পরে ওই কাগজেই অশ্বিনীবাবু নতুন করে সই করে ট্রেজারিতে পাঠিয়ে দেন বলে তাঁর দাবি।
পুরসভার ওই আধিকারিকের বক্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতেই বেশ কয়েকটি প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। এক, যে কাজটি পুর কর্তৃপক্ষের করার কথা, তার ভার সুভাষবাবু কেন এক কাউন্সিলর এবং ঠিকাদারের লোকের উপরে ছেড়ে দিলেন। দুই, পুরসভার হিসেবরক্ষকের দায়িত্বে থেকে সুভাষবাবু নিজে কী ভাবে পুরপ্রধানের জাল সই থাকা কাগজ ট্রেজারি অফিসে পাঠিয়ে দিলেন, সই নকলের বিষয়টি কেন তাঁর নজরে এল না। এবং প্রশ্ন উঠছে এও যে, অশ্বিনীবাবুর দ্বিতীয় বারের বক্তব্য মেনে তর্কের খাতিরে ধরে নেওয়া গেল ওটি নকল সই নয়। তিনিই কোনও ভাবে সই করতে কিছু ভুল করেছেন। সে ক্ষেত্রে এত বড় পরিমাণের একটি কাজের কাগজপত্রের সইয়ের মামলায় অশ্বিনীবাবু কেন পুর-পদ্ধতিকে এড়িয়ে ‘বাইপাস’ হয়ে কাউন্সিলর-ঠিকাদারের নিয়ে আসা কাগজে সই করলেন? শুক্রবার কোনও প্রশ্নেরই সদুত্তর মেলেনি।
আর এখানেই উঠে এসেছে ঠিকাদারদের প্রাপ্য মিটিয়ে দেওয়ার ক্ষেত্রে পুরসভার অন্দরেই সক্রিয় থাকা এক শ্রেণির অসাধু চক্রের কথা। যারা এ ভাবে নিজেরাই পুরসভার চেক ‘প্রসেস’ করার দায়িত্ব কাঁধে তুলে নেয় বলে অভিযোগ। পুরসভা সূত্রের খবর, পুরপ্রধান বিভিন্ন কাজে (যার অধিকাংশই তাঁর নিজস্ব ব্যবসার) সপ্তাহের বেশির ভাগ দিন শহরের বাইরে বাইরেই কাটান। যে কারণে পুরসভার সাফাইকর্মীদের বেতন পেতে প্রায় মাসই ১০–১২ তারিখ হয়ে যায়। একই অসুবিধা হয় ঠিকাদারদের পেমেন্ট পেতেও। আর এরই সুযোগ নেয় ওই চক্রটি। তার বিনিময়ে ঠিকাদারদের কাছ থেকে চড়া ‘কমিশন’ও মেলে বলে দাবি। অভিযোগ, এই গোটা চক্রে পুর কর্তৃপক্ষের একাংশও সক্রিয় ভাবে জড়িত। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক ঠিকাদারের দাবি, কমিশন নেওয়াকে কেন্দ্র করে দিন পনেরো আগেই দুই কাউন্সিলরের মধ্যে পুরসভার ভিতরেই গণ্ডগোল বেধেছিল। এ বার ওই চক্রটিই ঠিকাদারের পেমেন্টের ব্যবস্থা করতে গিয়ে পুরপ্রধানের স্বাক্ষর নকল করার মতো ‘কাঁচা’ কাজই করে ফেলেছে বলে পুরকর্মীদের একাংশের দাবি।
পুরপ্রধানের ‘স্বাক্ষর’ থাকা ওই কাগজ যে তিনিই পুরসভার হিসেবরক্ষকের কাছে নিয়ে গিয়েছিলেন, তা মেনে নিয়েছেন তৃণমূল কাউন্সিলর তথা পুরসভায় পূর্ত দফতরের কাজের দেখভালের ‘দায়িত্বপ্রাপ্ত’ আব্বাস হোসেন। তিনি খোলাখুলিই বলছেন, ‘‘ঠিকাদারদের পেমেন্ট পেতে যাতে অসুবিধা না হয়, তার জন্য আমি একটু আধটু চেষ্টা করি। এতে সকল ঠিকাদারদের সঙ্গে সুসম্পর্ক রেখে কাজের ক্ষেত্রে সুবিধা হয়।’’ তবে, পুরপ্রধানের সই জাল করেননি বলেই তাঁর দাবি। এ ক্ষেত্রে ঠিক কী হয়েছে, তা পুরপ্রধান ছাড়া কেউ বলতে পারবেন না বলেই ঘটনার দায় এড়িয়েছেন ওই তৃণমূল কাউন্সিলর।
এ দিকে, সই-কাণ্ডকে তেমন গুরুত্ব দিতেই নারাজ অশ্বিনীবাবু। বৃহস্পতিবার বিকেলে এ নিয়ে যোগাযোগ করা হলে তিনি দাবি করেন, ওই স্বাক্ষর তাঁর নয়। তাঁর অনুপস্থিতিতে কেউ সই নকল করেছেন। ট্রেজারিতে ধরা পড়তেই তিনি নতুন করে স্বাক্ষর করে কাগজ পাঠিয়ে দিয়েছেন। সন্ধ্যায় যখন পুরপ্রধানকে আবার ধরা হয়, শাস্তিযোগ্য অপরাধ হলেও পুরসভা কেন থানায় অভিযোগ দায়ের করছে না? আগের বক্তব্য থেকে সম্পূর্ণ ১৮০ ডিগ্রি সরে গিয়ে অশ্বিনীবাবু দাবি করেন, ‘‘অনেক সময় সই না মিলতেই পারে। এ ক্ষেত্রেও তা-ই ঘটেছে। আমি ফের স্বাক্ষর করার পরেই বিষয়টি মিটে গিয়েছে।’’ এমন স্পর্শকাতর ঘটনায় তৃণমূল পুরপ্রধানের এই উলটপুরান দেখে সই-কাণ্ডে অশ্বিনীবাবুর বিরুদ্ধেই পুরসভার অন্দরে ‘কমিশন-চক্র’কে মদত দেওয়ার অভিযোগ তুলেছেন বিরোধীরা।
ঘটনার তদন্তের দাবি জানিয়েছেন পুরসভার বিরোধী দলনেতা শুভাশিস চৌধুরী। পুরসভার কংগ্রেস কাউন্সিলর অমল শেখের বক্তব্য, ‘‘তৃণমূলের দশ জন কাউন্সিলর পুরসভাটা চালাচ্ছেন। তাঁরাই ঠিকাদারদের কাছ থেকে কমিশন খাচ্ছেন। সৎ সাহস থাকলে কে পুরপ্রধানের সই জাল করল, তা খুঁজে বের করে পুরসভা অভিযুক্তের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিক।’’ অন্য দিকে, নিজেদের স্বার্থেই পুরপ্রধান ঘটনাটিকে ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা করছেন বলে অভিযোগ সিপিএমের জেলা কমিটির সদস্য সঞ্জীব বর্মনের। প্রশাসন অবিলম্বে এফআইআর করে পুরসভায় জনগণের কোটি কোটি টাকা লুঠে জড়িতদের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ করুক বলে তাঁর দাবি।
অন্য দিকে, যাঁর কাজের পেমেন্ট নিয়ে এত কাণ্ড, সেই ঠিকাদার অসীম মণ্ডলের বক্তব্য, পুরসভার কাজ করেছি। পুরসভা টাকা পেমেন্ট করবে। সুতরাং চেকের প্রয়োজনীয় কাগজপত্রে কিছু গণ্ডগোল থাকলে তার দায় তাঁর নয় বলেই অসীমবাবু জানিয়েছেন। এ দিকে, এত কিছুর পরেও ঘটনার কথা জানা নেই বলে দাবি করেছেন পুরসভার সাব অ্যাসিন্টান্ট ইঞ্জিনিয়র ডাল্টন চট্টোপাধ্যায়। আর বিষয়টির খোঁজ নিয়ে দেখবেন বলেই দায় সেরেছেন রামপুরহাটের মহকুমাশাসক সুপ্রিয় দাস।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy