বিশ্বভারতীর ফলক-বিতর্কে নয়া মোড়। গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।
বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়কে বিশ্ব ঐতিহ্য ক্ষেত্র (ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইট)-এর স্বীকৃতি দিয়েছে ইউনেস্কো। তার পর বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ যে ফলক লাগিয়েছেন সেখানে, তা ঘিরে বিতর্ক ইতিমধ্যেই শোরগোল ফেলে দিয়েছে। সেই আবহে ওই ফলকের বয়ান কী হবে তা নিয়ে একটি নির্দেশিকা ছড়িয়ে পড়েছে। বাংলা, হিন্দি এবং ইংরেজি— তিন ভাষায় ওই বয়ান। বিশ্বভারতী সূত্রের দাবি, ফলকে কী লেখা হবে তার একটি বয়ান কর্তৃপক্ষ পাঠিয়েছিলেন ইউনেস্কোর কাছে। ওই সূত্রেরই দাবি, সেই বয়ানে সম্মতি দিয়েছে ইউনেস্কো। তার পরেই সেই বয়ান পাঠানো হয় ভারতীয় পুরাতত্ত্ব সর্বেক্ষণ বা ‘আর্কিয়োলজিক্যাল সোসাইটি অফ ইন্ডিয়া’ (এএসআই)-য়। বিশ্ববিদ্যালয়ের ওই সূত্রেরই দাবি, এএসআই-ও ওই বয়ানে সম্মত হয়েছে। যদিও বিশ্বভারতীরই একটি অংশ দাবি করছে, ইউনেস্কোর নামে আসলে নিজে ফলক-বিতর্ক থেকে বেরোতে চাইছেন উপাচার্য বিদ্যুৎ চক্রবর্তী। তাই মনগড়া বয়ান ছাপিয়ে ইউনেস্কোর নাম দিয়ে চালাতে চাইছেন।
সম্প্রতি কবিগুরুর বিশ্বভারতীকে বিশ্ব ঐতিহ্যক্ষেত্র বা ‘ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইট’ হিসাবে স্বীকৃতি দিয়েছে ইউনেস্কো। যে খবরে খুশির জোয়ার দেশ জুড়ে। এই উপলক্ষে বিশ্ব-ঐতিহ্যের পরিচিতি বহনকারী একাধিক ফলক বসানো হয় বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন জায়গায়। নবতম বিতর্কের সূত্রপাতও তখনই। দেখা যায়, বিশ্বভারতী কর্তৃপক্ষ নির্মিত সেই ফলকে রয়েছে আচার্য প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী এবং বর্তমান উপাচার্য বিদ্যুৎ চক্রবর্তীর নাম। কিন্তু ফলকে কোথাও স্থান পায়নি স্রষ্টা রবীন্দ্রনাথের নাম!
এ নিয়ে বিতর্ক তুঙ্গে ওঠে। আপত্তি তোলেন শান্তিনিকেতনের আশ্রমিক, পড়ুয়া, প্রাক্তনীরা। বিষয়টিতে লাগে রাজনীতির রংও। মুখ্যমন্ত্রী তথা তৃণমূলের সর্বময় নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ওই ফলকের তীব্র নিন্দা করে দলকে রবীন্দ্রনাথের ছবি বুকে ঝুলিয়ে প্রতিবাদ কর্মসূচি গ্রহণের নির্দেশ দেন। শান্তিনিকেতনের কবিগুরু মার্কেটে এখনও চলছে তৃণমূলের প্রতিবাদ সমাবেশ। যে সমাবেশ থেকে তাঁকে প্রাণনাশের হুমকি দেওয়া হচ্ছে বলে পুলিশে অভিযোগ জানিয়েছেন উপাচার্য বিদ্যুৎ। শুধু রাজ্যের শাসকদলই নয়, এ বিষয়ে উপাচার্যকে আক্রমণ শানিয়েছে বিরোধীরাও। সর্বোপরি, ফলক-বিতর্কে মুখ খুলে উপাচার্যকে কড়া বার্তা দেন বাংলার রাজ্যপাল সিভি আনন্দ বোসও। কিন্তু চাপেও কাজ হয়নি। বিতর্কিত ফলক সরেনি জায়গা থেকে। এই প্রেক্ষাপটে নতুন বয়ান ঘিরে তুঙ্গে উঠেছে ডামাডোল।
বিশ্বভারতী কর্তৃপক্ষ সূত্রে জানা গিয়েছে, ফলকে কী লেখা হবে তার একটি বয়ান বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ পাঠিয়েছিলেন ইউনেস্কোর কাছে। বিশ্বভারতীর পাঠানো বয়ানে সম্মতি জানিয়েছে তারা। তার পর সেই একই বয়ান পাঠানো হয় এএসআইতে। তারাও বয়ানে সম্মত হয়েছে। তার পরেই অশোক স্তম্ভ, বিশ্বভারতী, ইউনেস্কোর প্রতীক সম্বলিত কাগজে তিন ভাষায় ওই বয়ান লেখা হয়। সেই বয়ানই হাতে পেয়েছেন বিশ্বভারতীর সঙ্গে যুক্ত কেউ কেউ। যা পড়ে তাঁদের একাংশই প্রশ্ন তুলছেন, সামগ্রিক বয়ান নিয়ে। তাঁদের দাবি, ফলকে লেখা হবে বলে যে বয়ানটি সমাজমাধ্যমে ঘুরছে তার বাংলা শব্দচয়ন চোখে লাগে। অনেকেরই প্রশ্ন, ‘ডিজিটাল ট্রান্সলেটর’ (যেমন: গুগল ট্রান্সলেটর) ব্যবহার করে ইংরেজি থেকে বাংলায় অনুবাদ করা হয়েছে কি? তাঁদের আরও প্রশ্ন, নাম রাখা নিয়ে ফলক বিতর্ক তৈরি হয়েছিল। রবীন্দ্রনাথের নাম সেখানে ছিল না। কেবলমাত্র ছিল আচার্য প্রধানমন্ত্রী মোদী এবং উপাচার্য বিদ্যুতের নাম। তা নিয়ে চরম বিতর্ক হয়। নতুন বয়ানে কোনও নামই রাখা হয়নি। স্বভাবতই, আগের বারের মতো এ বারও তাতে নেই স্রষ্টা রবীন্দ্রনাথের নাম। এটা কতটা গ্রহণযোগ্য তা নিয়ে প্রশ্ন উঠছে। অনেকেই দাবি করছেন, নামবিতর্ক থেকে পিছু ছাড়াতেই উপাচার্য নিজে এমন বয়ান লিখে ইউনেস্কোর নাম করে চালাতে চাইছেন। যদিও এ ব্যাপারে বিশ্বভারতী কর্তৃপক্ষ আনুষ্ঠানিক ভাবে কিছু জানায়নি। ফলে ছড়িয়ে পড়া ফলক-বয়ানের সত্যতাও নিশ্চিত নয়।
বিশ্বভারতী ইউনিভার্সিটি ফ্যাকাল্টি অ্যাসোসিয়েশনের (ভিবিইউএফএ) সভাপতি সুদীপ্ত ভট্টাচার্য একে বিভ্রান্তি ছড়ানোর প্রচেষ্টা হিসাবে অভিহিত করেছেন। এমন কাজের তীব্র প্রতিবাদ জানিয়ে তিনি বলেন, ‘‘যখন জনসংযোগ আধিকারিক সংবাদমাধ্যমকে জানাচ্ছেন, এএসআই বা ইউনেস্কো থেকে ফলক সংক্রান্ত কোনও চিঠি তাঁদের কাছে আসেনি। কবে ইউনেস্কো স্বীকৃত ফলক বসবে তা-ও তাঁরা জানেন না। তখন একটি ছবি ছেড়ে দিয়ে প্রমাণ করার চেষ্টা চলছে যে, এএসআই বিশ্বভারতী কর্তৃপক্ষকে ফলকের বয়ান পাঠিয়েছে। তাতে রবীন্দ্রনাথেরও নাম নেই। সুতরাং, ফলকে রবীন্দ্রনাথের নাম যুক্ত করার আন্দোলন অর্থহীন। যে ছবিটি প্রচারিত হয়েছে তা ভুয়ো, কারণ তার দায় বিশ্বভারতী কর্তৃপক্ষ নেয়নি। কোনও সংস্থার ওয়েবসাইটেও এই ছবি নেই। প্রচারিত বয়ান কোনও হেরিটেজ ফলকেরও নয়। তা নেহাতই ঐতিহ্য ক্ষেত্রে শান্তিরক্ষার বিজ্ঞপ্তি।’’ স্বভাবতই, এই ঘটনার জেরে ফলক-বিতর্ক আরও বৃদ্ধি পাওয়ার সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy