সাজিনা গ্রামে চিন্তামণি কালীর বিসর্জনের দিন দুপুরে যাত্রা। —ফাইল চিত্র।
কোথাও যাত্রা শুনে তবেই মন্দির ছেড়ে বিসর্জনের পথে পা বাড়ান দেবী। কোথাও আবার যাত্রা দেখে তার পরেই মন্দিরে আসেন দেবী। সিউড়ি সংলগ্ন একাধিক গ্রামে এ ভাবেই কালীপুজোর সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে যাত্রার কিংবদন্তী। এই গ্রামগুলিতে পুজোর অনুষঙ্গে যাত্রা আয়োজন হয় না, বরং যাত্রা এখানে পুজোর আয়োজনের অন্যতম অংশ। আর এই নিয়মের হাত ধরেই হারিয়ে যেতে বসা এক লোকশিল্প বেঁচে রয়েছে এই গ্রামগুলিতে।
গ্রাম বাংলার এক সময়ের অতিপরিচিত লোকশিল্প গ্রামীণ যাত্রা এখন কার্যত বিলুপ্তির পথে। কয়েক দশক আগে পর্যন্তও গোটা শীতকাল জুড়ে গ্রামে গ্রামে বসত যাত্রার আসর। এখন সান্ধ্য টেলি-সিরিয়ালের ভিড়ে সেই ঐতিহ্য হারিয়ে যেতে বসেছে বলে অভিযোগ৷ তবে সিউড়ি ২ ব্লকের দু’টি গ্রামের কালীপুজোর সঙ্গে আজও জড়িয়ে রয়েছে যাত্রা।
প্রচলিত বিশ্বাস মতে, পুরন্দরপুর পঞ্চায়েতের অন্তর্গত সাজিনা গ্রামের ‘মা চিন্তামণি’ যাত্রা না দেখে বিসর্জনের পথে যান না। কয়েক’শো বছরের প্রাচীন এই কালীপুজোয় যাত্রার শুরু কবে থেকে, তা নিশ্চিত বলতে না পারলেও গ্রামের প্রবীণদের দাবি, ১৫০-২০০ বছর আগে শুরু হয়েছিল এই পরম্পরা। এক সময়ে এই যাত্রায় নিয়মিত অংশগ্রহণ করতেন গ্রামের বাসিন্দা অরুণ চট্টোপাধ্যায়। ৬৫ বছর বয়সে এসেও যাত্রার গল্প বলতে গিয়ে কোনও ক্লান্তি নেই তাঁর।
অরুণ বলেন, ‘‘যাত্রা আয়োজন না করে দেবীর বিসর্জন হলে, কোনও না কোনও অমঙ্গল ঘটেই। তাই, বহু বছর আগে গ্রামের বাসিন্দারাই ‘জয়কালী অপেরা’ নামে একটি যাত্রার দল শুরু করেছিলেন। মাঝে কিছু দিন বাইরের দল এসেও যাত্রা করত। ১৯৭১ সালে নকশাল আন্দোলনের কারণে যাত্রা হয়নি। সে বছরই গ্রামে একাধিক অঘটন ঘটে। এর পরে আবারও গ্রামের বাসিন্দারা মিলিত হয়ে ‘জয়কালী অপেরা’র কাজ শুরু করেন।’’
গ্রামবাসীরা জানান, ১৯৭২ সালে ‘নেভাও আগুন’ যাত্রাপালা দিয়ে অপেরার নতুন করে পথচলা শুরু হয়েছিল। এ বছরও গ্রামের নতুন প্রজন্মের ছেলেরা সেই যাত্রাপালাই পরিবেশন করবেন কালীপুজোর পরের দিন দুপুরে। আর যাত্রা দেখে দিনের আলো থাকতেই বিসর্জনের পথে এগিয়ে যাবেন দেবী।
সাজিনার থেকে কিছুটা দূরেই রয়েছে ইন্দ্রগাছা গ্রাম। সেখানে দুর্গাপুজোর পরের ত্রয়োদশীতে মূল মন্দির থেকে বামাকালীর প্রতিমাকে নিয়ে যাওয়া হয় গঠন মন্দিরে। সেখানে নতুন ভাবে সাজিয়ে কালীপুজোর রাতে প্রতিমা আবার আদি মন্দিরে ফিরিয়ে আনা হয়। কিন্তু এই ফিরে আসার আগে দীর্ঘদিনের রীতি মেনে গঠন মন্দিরের সামনে আয়োজিত হয় যাত্রাপালা। সেই যাত্রা শেষ হওয়ার পরেই প্রতিমাকে নিয়ে আসা হয়।
গ্রামের বাসিন্দা হরি মণ্ডল বলেন, “আমরা একাধিক বার অর্কেস্ট্রা, ব্যান্ডের গান প্রভৃতি অনুষ্ঠান করে দেখেছি। কিন্তু প্রতি বারই কোনও না কোনও বাধা এসেছে। আমাদের মা যাত্রা শুনতেই ভালবাসেন। তাই এখন আর কোনও পরীক্ষানিরীক্ষার পথে না হেঁটে প্রতি বছরই যাত্রাপালা আয়োজিত হয়।’’ এখানেও গ্রামের বাসিন্দারাই যাত্রাপালায় অভিনয় করেন। রাত ন’টা নাগাদ অভিনয় শুরু হয়। মধ্যরাত্রে যাত্রা শেষের পর ভক্তদের কাঁধে চেপে গঠন মন্দির থেকে আদি মন্দিরে আসেন দেবী।
তবে, শুধু ধারাকে বাঁচিয়ে রাখা নয়, যাত্রা যাতে দর্শকদের ভাল লাগে, সে দিকেও নজর রাখা হয়। অভিনয়ের দিন সাজ ও প্রসাধন নিয়ে চেনা মানুষই অচেনা রূপে মঞ্চে উঠে আসেন। লোকবিশ্বাস হোক বা ঐতিহ্য— এ ভাবে আজও একটি বিলুপ্তপ্রায় শিল্পমাধ্যমের চর্চা চলছে বলে দাবি গ্রামবাসীর।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy