রাজগ্রাম পাথর শিল্পাঞ্চল। নিজস্ব চিত্র।
২১-এর বিধানসভার ব্যবধান দূর অস্ত্, যে মুরারই বিধানসভা ১৯-এর লোকসভায় তৃণমূল প্রার্থী শতাব্দী রায়কে প্রায় ৭০ হাজারের লিড দিয়ে তাঁর জয়ের পথ ‘প্রশস্ত’ করেছিল, সেখানেই লিড কমল শতাব্দীর। ভোটের দিন সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত শতাব্দী বীরভূম লোকসভার এই অংশে কাটানোর পরেও তৃণমূলের লিড কমে দাঁড়াল প্রায় ৫০ হাজার। আগের লোকসভা থেকে দ্বিগুণের বেশি ভোট পেলেন সিপিএম সমর্থিত কংগ্রেস প্রার্থী মিল্টন রশিদের। বিজেপিকে সরিয়ে তিনিই উঠে এলেন দ্বিতীয় স্থানে।
তৃণমূল সূত্রে খবর, এই ফলের পিছনে ‘গোষ্ঠীকোন্দল’ই দায়ী। যার ‘প্রছন্ন সমর্থন’ পাওয়া গিয়েছে ভোটে জেতার পরে নানা সংবর্ধনা সভায় শতাব্দীর বক্তব্যেও। তাঁকে বলতে শোনা যায়, ‘‘দলে থেকে যাঁরা দলের ভোট করেননি, তাঁদের নামের তালিকা রাজ্যে পাঠানো হবে। সে ক্ষেত্রে মুরারই বিধানসভা আলাদা নয়। এই ভোটটি আমি খুব কাছে থেকে দেখেছি।’’ অন্য দিকে, তৃতীয় স্থানে নেমে যাওয়ার জন্য শেষ মুহূর্তে প্রার্থী পরিবর্তন ও দুর্বল সংগঠন দায়ী বলে মত বিজেপির।
তৃণমূল সূত্রে খবর, সংখ্যালঘু প্রধান এই বিধানসভা বরাবরই তৃণমূলকে ঝুলি উপুড় করে দিয়েছে। এ বার তৃণমূল এগোলেও কমেছে ব্যবধান। তৃণমূল সূত্রে খবর, ২৩-এর পঞ্চায়েত নির্বাচনের আগে থেকেই মুরারইয়ের বিধায়ক মোশারফ হোসেনের সঙ্গে মুরারই ১ ব্লক সভাপতি বিনয় ঘোষ ও মুরারই ২ ব্লক সভাপতি আফতাবুদ্দিন মল্লিকের প্রার্থী নির্বাচন-সহ বিভিন্ন বিষয় নিয়ে ‘মতান্তর’ দেখা যায়। তার পরেও ২০২৩ সালের পঞ্চায়েত নির্বাচনে মুরারই ১ ব্লকের সাতটি পঞ্চায়েত ও পঞ্চায়েত সমিতিটি দখল করেছে তৃণমূল। মুরারই ২ ব্লকের ছ’টি পঞ্চায়েতের মধ্যে পাইকর ১ পঞ্চায়েত ও জাজিগ্রাম পঞ্চায়েত ছাড়া বাকি পঞ্চায়েত দখল করে তৃণমূল। পঞ্চায়েত সমিতিও দখল করে তৃণমূল। এখানের জেলা পরিষদের সব আসনে জিতেছিল তৃণমূল।
তৃণমূল সূত্রে খবর, পঞ্চায়েতে দলের প্রার্থী হতে না পরে অনেক নির্দল হয়ে দাঁড়ান। ভোটের পরে এঁদের অনেকেই দলে ফিরে আসেন। পাশাপাশি, সিপিএম ও কংগ্রেস থেকেও অনেকে তৃণমূলের যোগ দেন। ফলে, দলের মধ্যে অসন্তোষ তৈরি হয় বলে অভিযোগ। লোকসভা ভোটের কয়েক মাস আগে মুরারই ১ ব্লকের ডুমুর গ্রাম পঞ্চায়েতে তৃণমূলের বর্তমান প্রধান ও প্রাক্তন প্রধানের সমর্থকদের গোষ্ঠীকোন্দলে ঘরবাড়ি ভাঙচুর ও মারপিটের ঘটনা ঘটে। অন্য দিকে, মুরারইয়ের ত্রিস্তর পঞ্চায়েতে ন’বারের প্রতিনিধি প্রদীপকুমার ভকত ২৩-এর পঞ্চায়েত নির্বাচনে জেলা পরিষদ নির্বাচিত হয়েও তাঁকে কর্মাধ্যক্ষ করা হয়নি। যা নিয়ে কর্মীদের মধ্যে ক্ষোভ ছিল। যার প্রভাব ২৪-এর লোকসভায় পড়েছে বলে মনে করছে তৃণমূলের একাংশ। তাই পাইকর-১ ও জাজিগ্রাম পঞ্চায়েতে এই লোকসভায় লিড পেলেও মোট ভোট কমেছে। এ বার মুরারই ১ ব্লক প্রায় ৩২ হাজার ও মুরারই ২ ব্লকে প্রায় ২৭ হাজার ভোটে লিড পায় তৃণমূল। ১৯-এর লোকসভায় যা ছিল যথাক্রমে ৩৭ হাজার ও ৩২ হাজার। দু’ব্লকেই ২৪-এ দ্বিতীয় স্থানে আছেন মিল্টন।
বিনয় বলেন, “পঞ্চায়েতে প্রার্থী বাছাইয়ে নেতৃত্বের ভুল ছিল। তৃণমূলের প্রার্থীদের হারিয়ে কংগ্রেস, সিপিএম ও নির্দল যাঁরা জিতেছিলেন তাঁদের আলোচনা ছাড়া দলে নেওয়ার বিরুদ্ধে ছিলাম। এর প্রভাব ভোটে পড়েছে। তবে অনুব্রত মণ্ডলের তৈরি করে যাওয়া সংগঠন, সাংসদ হিসেবে শতাব্দী রায়ের উন্নয়নের কাজ ও লক্ষ্মীর ভান্ডারের জন্য ভোট পেয়েছি। বুথ ধরে ফল নিয়ে আলোচনা হবে।”
অন্য দিকে, বিধায়ক বলেন, ‘‘দুই ব্লক সভাপতি লোকসভা ভোটে আমাকে কোনও কর্মসূচিতে ডাকেননি। সাংগঠনিক ভাবে আমাকে এক প্রকার বয়কট করেছিলেন দুই ব্লক সভাপতি। তাই নিজেই প্রচার করছি। কেন এই ঘটনা ঘটল তার ময়না তদন্ত করতে হবে। তবে শতাব্দী রায় জিতেছেন এটাই বড় কথা। নিচুতলার কর্মীদের একান্ত পরিশ্রমে এই ফল।’’
যদিও মুরারই ২ ব্লক সভাপতি আফতাবুদ্দিন মল্লিক বলেন, ‘‘বিধায়ককে যেখানে প্রয়োজন ছিল সেখানে আমন্ত্রণ করা হয়েছে। বাকি জায়গায় দলীয় কর্মীরা ভোট করেছেন।’’ তবে তৃণমূলের জেলা সহ সভাপতি মলয় মুখোপাধ্যায় বলেন, ‘‘পঞ্চায়েতে প্রার্থী বাছাই নিয়ে মুরারই বিধানসভায় বিধায়ক ও মুরারই ১ ও ২ ব্লকের সভাপতির সঙ্গে মতান্তর তৈরি হয়েছিল বলে জেনেছি। তবে লোকসভা ভোটে সকলে ভোট করিয়েছেন। দিনশেষে বীরভূমে সব থেকে বেশি লিড মুরারই দিয়েছে।’’
অন্য দিকে, ১৯-এর লোকসভা ভোটের পরে ক্রমাগত এই বিধানসভায় বিজেপির ভোট কমেছে। যদিও এ বার মুরারই, পাইকর, চাতরা, রাজগ্রামের শহরাঞ্চলে এলাকার বিভিন্ন বুথে দল লিড পেয়েছে বলে বিজেপি সূত্রে জানা গিয়েছে। তবে তৃণমূল নেতৃত্বের দাবি, জেলার শহর এলাকায় তৃণমূলের ফল খারাপ হয়েছে। বিজেপি সূত্রে খবর, এ বার তাদের বিরোধী ভোটের একাংশ মিল্টন পেয়েছেন। বিজেপির বীরভূম সাংগঠনিক জেলার সম্পাদক অরিন দত্ত বলেন, ‘‘শেষ মুহূর্তে প্রার্থী পরিবর্তন একটি বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছিল মুরারই বিধানসভার ক্ষেত্রে। দেবাশিস ধর এই এলাকার অধিকাংশ গ্রামে প্রচার করে ফেলেছিলেন। এ ছাড়া সংগঠন দুর্বল বলে ভোট কমেছে।’’
অন্য দিকে, কংগ্রেসের প্রার্থী মিল্টন রশিদ বলেন, ‘‘মুরারই বিধানসভার মানুষজন আমাকে দু’হাতে আশীর্বাদ করেছেন। তাই ভোট দ্বিগুণ হয়েছে। ভোটে হারলেও মুরারই বিধানসভার মানুষজনের পাশে সব সময় থাকব।” সিপিএমের জেলা সম্পাদক মণ্ডলীর সদস্য সঞ্জীব বর্মণ বলেন, ‘‘মুরারই বিধানসভার সংখ্যালঘু ভোটারেরা যে রায় দিয়েছেন, তাতে বলা যায় ধর্মীয় মেরুকরণ ব্যর্থ হয়েছে। ভোট উৎসবে এটাই কাম্য।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy