ইংরেজি লেখার পাশাপাশি বলাটাও অনেকের কাছে ভীতির বিষয়। ছবি: আইস্টক
বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থায় বাংলা মাধ্যমের পড়ুয়াদের ইংরেজি-ভীতি একটি গুরুত্বপূর্ণ ও বহুচর্চিত বিষয়। ব্রিটিশ-শাসিত ভারতে ইংরেজি ভাষার আধিপত্যের শুরু এবং ইংরেজরা এ দেশ ছাড়ার পরেও দেশের বিভিন্ন রাজ্যে ইংরেজির আধিপত্য নয়, বলা ভাল দৌরাত্ম্য শুরু হয়েছে। আমাদের রাজ্যও তার ব্যতিক্রম নয়। চারদিকে ইংরেজি মাধ্যম স্কুলের ছড়াছড়ি এখন। কারণও সকলের জানা। উচ্চশিক্ষা পেতে ইংরেজি ছাড়া বিকল্প নেই। বিশেষ করে বিজ্ঞান নিয়ে যাঁরা উচ্চশিক্ষায় আগ্রহী, ইংরেজি ভাষায় মোটামুটি একটা দখল না থাকলে ভীষণই সমস্যায় পড়তে হয়। ইংরেজিতে লেখা বিজ্ঞানের অনেক বইয়ের বাংলা অনুবাদ তো দূরঅস্ত, অনেক শব্দের বাংলা পরিভাষাই নেই।
সত্যি কথা বলতে কী, যে কোনও বিদেশি ভাষাই আয়ত্ত করা যথেষ্ট কঠিন। কম মেধা বা সাধারণ মেধার পড়ুয়াদের কাছে তা আরও কষ্টকর মনে হতেই পারে। ইংরেজিও তার ব্যতিক্রম নয়। বাংলা মাধ্যমে পড়লেও নিজেদের মেধার জোরেই ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, রামমোহন রায়, নীরদ সি চৌধুরীরা ইংরেজিতে অগাধ পাণ্ডিত্য অর্জন করেছিলেন, যা তদানীন্তন ইংরেজ সাহেবদেরও চমকে দিত। তবে এঁরা ছিলেন অসাধারণ মেধাসম্পন্ন। আর পাঁচ জনের সঙ্গে তুলনা করা বোকামো। তবে সেই ছবিটার বিশেষ বদল ঘটেনি। ইংরেজ আমলে সরকারি চাকরি পেতে ইংরেজি জানাটা জরুরি ছিল। আর আজও উচ্চশিক্ষা বা নামী প্রতিষ্ঠানে চাকরির জন্য ইংরেজিতে দখল থাকতেই হবে।
এখন প্রশ্নটা এই যে, ইংরেজি শিক্ষার চল তো নতুন নয়। তবে পড়ুয়াদের ইংরেজি-ভীতি কাটছে না কেন। বরং তা উত্তরোত্তর বেড়েই চলেছে। সাম্প্রতিক অতীতে বেশ কিছু মর্মান্তিক ঘটনার সাক্ষীও আমাদের হতে হয়েছে যেখানে পড়ুয়াদের আত্মহননের সম্ভাব্য কারণ হিসেবে ইংরেজিতে দুর্বলতাই সামনে উঠে এসেছে।
এই দুর্বলতার কারণ কী? পঠনপাঠন বা সিলেবাসগত সমস্যা? বর্তমানে বিশেষত বাংলা মাধ্যম স্কুলগুলিতে অন্য বিষয়ের মতো ইংরেজির সিলেবাসেও অনেক রদবদল ঘটেছে। পরীক্ষায় অতিসংক্ষিপ্ত, সংক্ষিপ্ত প্রশ্নেরই আধিক্য। যার প্রভাব পড়ছে পড়ানোর ধরনেও। সহজ সিলেবাস এবং সংক্ষিপ্ত প্রশ্নের বাড়বাড়ন্তে মাধ্যমিক বা উচ্চ মাধ্যমিকে গাদা গাদা নম্বর পেয়ে পাশ করছে অধিকাংশ পড়ুয়াই। কিন্তু এতে তাদের গুণগত উৎকর্ষ মোটেই বাড়ছে না। আর লক্ষ্যও এখন, শেখা নয় বরং পরীক্ষায় বেশি নম্বর পাওয়া। তার ফলে প্রকৃত শিক্ষালাভ হচ্ছে না এবং উচ্চশিক্ষার শুরুতেই ইংরেজিতে বেশি বেশি নম্বর পাওয়া এই সব পড়ুয়াদের বেশির ভাগই মুখ থুবড়ে পড়ছে।
তবে এই সমস্যার মূল কিন্তু প্রাথমিক স্তরের শিক্ষাব্যবস্থাতেই নিহিত রয়েছে। দীর্ঘদিনের শিক্ষকতার অভিজ্ঞতায় বলতে পারি, চতুর্থ শ্রেণি উত্তীর্ণ যে সব পড়ুয়া হাই স্কুলে ভর্তি হয়, তাদের বেশির ভাগই ইংরেজিতে মাত্রাতিরিক্ত দুর্বল এবং পঞ্চম শ্রেণির ইংরেজির সিলেবাস অনুসরণ করতে গিয়ে হিমশিম খায়। ইংরেজি-ভীতির সূত্রপাত এখানেই।
সময় যত এগোয়, ছেলে বা মেয়েটি এক ক্লাস থেকে অন্য ক্লাসে উঠতে থাকে। কিন্তু ইংরেজি শিক্ষায় যে ঘাটতি তা আর পূরণ হয় না। ইংরেজির মতো বিষয়ে মোটামুটি দখল তৈরির জন্য ধারাবাহিকতা বজায় রাখা দরকার। অনেক ক্ষেত্রেই তাতে ঘাটতি দেখা যায়। আজও অনেক অভিভাবক সন্তানদের পড়াশোনার বিষয়ে উদাসীন। তারা নিয়মিত স্কুলে আসছে কিনা, পড়াশোনায় কতটা উন্নতি করছে, তা জানতে আদৌ আগ্রহী নন। স্কুলে ভর্তি করেই তাঁরা ভাবেন, দায়িত্ব মিটল। এর উপরে সমস্যা বাড়িয়েছে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত পাশ-ফেল না থাকাটা। সাধারণ ও নিম্ন মেধার পড়ুয়ারা আর পাঁচটা বিষয়ের মতো ইংরেজিতে বিনা বাধায় বাৎসরিক পরীক্ষার বৈতরণী পার হচ্ছে। শ্রেণিকক্ষে পাঠদানের সীমাবদ্ধতাও এখানে উল্লেখ করা দরকার। এক জন শিক্ষকের পক্ষে গড়ে ৭০-৮০ পড়ুয়ার প্রতি সমান ভাবে নজর দেওয়া অসম্ভব। এতে বিশেষ করে দুর্বল পড়ুয়ারা বেশি ভোগে।
সমস্যা গভীর, তাতে সন্দেহ নেই। তবে কিছু ব্যবস্থা নেওয়া গেলে পরিস্থিতির বদল ঘটানো সম্ভব। আর তা শুরু করতে হবে একেবারে প্রাথমিক স্তর থেকেই। রঙিন ঝকঝকে বই, মানানসই শিক্ষা-সরঞ্জামের মাধ্যমে পড়ুয়াদের কাছে ইংরেজিকে মজাদার করে তুলতে হবে। আর পাঁচটা বিষয়ের মতো ইংরেজির ক্ষেত্রেও মুখস্থবিদ্যা আউড়ে পরীক্ষার গণ্ডি পেরিয়ে যাওয়ার প্রবণতা দেখা যায়। তা রুখতে হবে। ছেলেমেয়েদের ইংরেজি লিখনের ক্ষেত্রে কুশলী করে তোলা বেশি দরকার। তা হলেই ইংরেজিতে দখল বাড়বে। ক্লাসে ক্লাসে সিলেবাসও সে ভাবেই তৈরি করতে হবে। ক্লাসে পড়ুয়ার সংখ্যা একান্তই কম করা না গেলে আলাদা করে ‘টিউটোরিয়াল’ ক্লাসের ব্যবস্থা করা যেতে পারে। ইংরেজি শিখতে যাতে পড়ুয়া ভয় না পায়, সে দিকে নজর দেওয়া বেশি জরুরি। আর তার দায়িত্ব শিক্ষকেরই। অনেক স্কুলে ইংরেজি শিক্ষকেরও অভাব রয়েছে। তা পূরণেও শিক্ষা দফতরকে সচেতন হতে হবে।
বাম আমলে দীর্ঘ সময় প্রাথমিক স্তরে ইংরেজি শিক্ষার সুযোগ ছিল না। তার প্রভাব এখনও বর্তমান কি না, তা আলোচনাসাপেক্ষ। তবে ফেলে আসা সময়ের দিকে না তাকিয়ে আমাদের বর্তমান ও আগামী প্রজন্ম যাতে ইংরেজিকে ভয় পেয়ে নয়, ভালবেসে আত্মস্থ করতে পারে, সেই লক্ষ্যেই শিক্ষক-শিক্ষিকা ও অভিভাবকদের কাজ করতে হবে।
লেখক প্রাক্তন শিক্ষক
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy