সন্তানহারা: কান্নায় ভেঙে পড়ছেন সুকুমারবাবু। তাজপুর গ্রামে রবিবার। নিজস্ব চিত্র
মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ার মতো খবরটা এসেছিল। শনিবার সকালে কোতুলপুরের তাজপুর গ্রামের সুকুমার রুইদাস ফোনে জানতে পারেন, তাঁর মেয়ে সমাপ্তির মৃত্যু হয়েছে কলেজের হস্টেলে। তার পরে একটা পুরো দিন ঘোরের মধ্যে কেটে গিয়েছে। রাতে মেয়ের দেহ নিয়ে কলকাতা থেকে ফিরে এসেছেন গ্রামের বাড়িতে। সৎকার করেছেন। আর তার পরে একেবারে ভেঙে পড়েছেন বছর পঁয়তাল্লিশের সুকুমারবাবু। রবিবার সকাল থেকে বাড়িতে ছিল পাড়া-পড়শি-নেতা-মন্ত্রী-সংবাদমাধ্যমের ভিড়। তা এড়াতে বার বার ছুটে বাইরে চলে গিয়েছেন সুকুমারবাবু। কখনও বসেছেন গাছতলায়। কখনও মোড়ের একটা দোকানের আড়ালে।
শনিবার কলকাতার ন্যাশনাল মেডিক্যাল কলেজের হস্টেলের পাঁচ তলার বারান্দা থেকে উদ্ধার হয় সমাপ্তি রুইদাসের (১৮) ঝুলন্ত দেহ। তাজপুর গ্রামের সমাপ্তি স্থানীয় হাইস্কুল থেকে এ বছর উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করেছিলেন। লক্ষ্মীপুজোর পরে নার্সিং-এর প্রশিক্ষণ নিতে ন্যাশনাল মেডিক্যালের হস্টেলে গিয়ে উঠেছিলেন। স্বাস্থ্য দফতর প্রাথমিক ভাবে এই মৃত্যুকে ইংরেজির ভীতি থেকে আত্মহত্যা বলে মনে করছে। তবে তা মানতে নারাজ পরিবার। তাঁদের অভিযোগ, হস্টেলে র্যাগিং হত সমাপ্তির উপরে।
পরিজনেরা জানাচ্ছেন, শনিবার সকালে প্রথম ফোনটা আসে সুকুমারবাবুর মোবাইলে। হাসপাতাল থেকে জানানো হয়, তাঁর মেয়ে অসুস্থ। তড়িঘড়ি বেরিয়ে পড়েন তিনি। পথে আবার ফোন আসে। জানতে পারেন, মেয়ের মৃত্যু হয়েছে। আবার কোতুলপুরে ফিরে এসে থানা এবং পঞ্চায়েত থেকে নথিপত্র নিয়ে রওনা হন। রাত ১০টা নাগাদ মেয়ের দেহ নিয়ে বাড়ি ফেরেন সুকুমারবাবু। সঙ্গে গিয়েছিলেন তাঁর কয়েক জন বন্ধু। তাঁরা জানাচ্ছেন, পথের ঝাঁকুনির সময়ে দু’হাত দিয়ে মেয়ের দেহ ধরে রাখছিলেন তিনি। পরিজনেরা জানান, রাতে যখন স্থানীয় শ্মশানে সমাপ্তির দেহ সৎকার হচ্ছে, সুকুমারবাবু ঠায় দাঁড়িয়েছিলেন বাইরে। ভোরে বাড়ি ফিরে আসার পরেই কান্নায় ভেঙে পড়েন তিনি।
বুলাদেবীকে সান্ত্বনা মন্ত্রীর। তাজপুর গ্রামে রবিবার। নিজস্ব চিত্র
শনিবার রাতে মেয়ের দেহ দেখেই জ্ঞান হারান সমাপ্তির মা বুলা রুইদাস। সেই ইস্তক তিনি শয্যাশায়ী। এ দিন রাজ্যের পঞ্চায়েত ও গ্রামোন্নয়ন প্রতিমন্ত্রী শ্যামল সাঁতরা তাঁদের বাড়িতে গেলে বুলাদেবী বলেন, ‘‘আমার মেয়ে খুবই ভীতু ছিল। গলায় দড়ি দিয়ে ও আত্মহত্যা করতেই পারে না। আমরা চাই আসল কারণটা সামনে আসুক।’’ সমাপ্তির খুবই কাছের ছিল সপ্তম শ্রেণির পড়ুয়া বোন সঞ্চিতা। ঘটনার পরে থম হয়ে রয়েছে সে। বাড়িতে প্রচুর লোক, সংবাদমাধ্যম। কোনও রকমে সামাল দেওয়ার চেষ্টা করছে ষষ্ঠ শ্রেণির পড়ুয়া সমাপ্তির ভাই পিনাকী। আর বলছে, ‘‘এ বার বাবার কী হবে? মায়ের কী হবে?’’ সমাপ্তির ঠাকুমা বৃদ্ধা চাঁপা রুইদাস আক্ষেপ করছিলেন, ‘‘উচ্চ মাধ্যমিকের পরে বলেছিলাম, আর পড়িয়ে কী হবে? ছেলে বলেছিল, মেয়ে চাকরি করবে। ওকে নিয়ে অনেক স্বপ্ন ছিল। এই দিনটা যে দেখতে হবে, কখনও ভাবিনি।’’
শান্ত স্বভাবের মেয়েটির মৃত্যু মেনে নিতে পারছে না তাজপুর। সমাপ্তির প্রতিবেশী সোমা রুইদাস, তনুশ্রী রুইদাসরা রবিবার বলেন, ‘‘কোন সাহসে আমরা আমাদের গ্রামের ছেলেমেয়েদের শহরে পড়তে পাঠাব? গ্রামের মেয়েটা আজ এখানে পড়াশোনা করলে হয়তো এ ভাবে অকালে চলে যেতে হত না।’’ শ্যামলবাবু বলেন, ‘‘আমরা ওই পরিবারের পাশে রয়েছি। এ রকম ঘটনা আর যেন না হয় তা আমাদের নিশ্চিত করতে হবে।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy