দুর্ঘটনায় চুরমার হয়ে গিয়েছে বিজয়দের গাড়ির ইঞ্জিন। বিয়ের দিনে সান্ত্বনা ও বিজয় (ইনসেটে)। ছবি: অভিজিৎ সিংহ ও নিজস্ব চিত্র
ছাদে নানা মাঙ্গলিক উপাচার ছড়িয়ে। পিঁড়ি দু’টোও সরানো হয়নি। মোটে আট দিন হল বিয়ে হয়েছে। বাড়িতে উৎসবের রেশ। অষ্টমঙ্গলায় নতুন বউকে নিয়ে ছেলে শ্বশুরবাড়ি যাবে বলে বেরিয়েছে। মায়ের মোবাইল বেজে উঠল। ছেলের নম্বর। ভেবেছিলেন, ভালয় ভালয় পৌঁছে গিয়েছে সেটা বলতেই ফোন করেছে।
কিন্তু ফোনটা করেছিল অন্য এক জন। সারেঙ্গার ব্রাহ্মণডিহা গ্রামের তাপসী পাল জানতে পারেন, বিরাট দুর্ঘটনা ঘটে গিয়েছে। তাঁর ছেলের গাড়িতে উল্টো দিক থেকে আসা একটা ট্রাক ধাক্কা দিয়েছে। সন্ধ্যা পর্যন্ত ওই একটাই খবরের ধাক্কায় চুরমার হয়ে রয়েছেন তাপসীদেবী। ঘটনাস্থলেই যে মৃত্যু হয়েছে তাঁর স্বামীর, ছেলের এবং বৌমার এক দাদার, বৌমা নিজে মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়ছে— সেই কথা তাঁকে বলে উঠতে পারেননি কেউ। তিনি শুধু জানেন, খবরটা পাওয়ার পরেই মেয়ে ছুটে চলে গিয়েছে বাঁকুড়া মেডিক্যালে। সঙ্গে গিয়েছে এলাকার আরও কয়েক জন। কিন্তু তার পরে আর কোনও খবর পাচ্ছেন না তাপসীদেবী। খালি জিজ্ঞাসা করে চলেছেন, ‘‘ওরা কেমন আছে? আমাকে কেন কেউ কিছু বলছে না?’’ প্রতিবেশীরা কোনও রকমে শুধু বলছেন, ‘‘সব ঠিক হয়ে যাবে।’’
আজ শুক্রবারের আগের শুক্রবার, ২১ জুন সারেঙ্গার ব্রাহ্মণডিহার বিজয় পালের সঙ্গে বিয়ে হয়েছিল পুরুলিয়ার হুড়ার রামপুরের সান্ত্বনার। শনিবার ব্রাহ্মণডিহায় ফিরে আসেন তাঁরা। প্রায় গোটা গ্রামটাই ভেঙে পড়েছিল বিজয়দের বাড়িতে। নবদম্পতিকে আশীর্বাদ করতে। বিজয় বেশ জনপ্রিয় ছিলেন এলাকায়। ছোটবেলা থেকেই ক্রিকেট আর ক্যারামের হাত বেশ ভাল। গ্রামজুড়ে তার অনেক বন্ধু। বাবা আর ছেলে, দু’জনেই স্থানীয় ব্রাহ্মণডিহা সাংস্কৃতিক গোষ্ঠী নামের একটি ক্লাবের সক্রিয় সদস্য। বিজয় নিজে একটি কম্পিউটার সেন্টার চালাতেন। আর তাঁর বাবা সঞ্জয় পালের বাড়ির মধ্যেই কাপড়ের দোকান।
“মনে হচ্ছে যেন দুঃস্বপ্ন দেখছি,” বলছিলেন গ্রামের বাসিন্দা সুরজিৎ সিংহ। সঞ্জয়বাবু ছিলেন তাঁর ঘনিষ্ঠ বন্ধু। বলেন, ‘‘ছেলের বিয়ের জন্য কত কত খাটাখাটনি করল এই তো সে দিন।’’ সঞ্জয়বাবুর অন্য একটা কাজ ছিল এ দিন। ছেলে-বউমার সঙ্গে বেরিয়েছিলেন। দুর্ঘটনায় কেড়ে নিয়েছে তাঁর প্রাণ। বিজয়ের বন্ধু শ্রীমন্ত পাত্র, সুমিত সিংহদের আক্ষেপ, “বিয়ে দিতে নিয়ে গিয়েছিলাম আমরা। কত আনন্দ হয়েছিল সেই দিন। বাবা, মা, স্ত্রীকে নিয়ে ভরা সংসারের স্বপ্ন দেখত ছেলেটা। সেটা যে এ ভাবে ছারখার হয়ে যেতে পারে, কেউ কোনও দিন ভাবিনি।’’
দুর্ঘটনার খবর পেয়ে রামপুর থেকে বাঁকুড়া মেডিক্যালে ছুটে আসেন সান্ত্বনার পরিবারের লোকজন। সান্ত্বনার মা রেখা খাঁ, বাবা সমরচন্দ্র খাঁ, মৃত্যুঞ্জয়ের দাদা প্রদীপ খাঁর সঙ্গে দেখা হল সেখানেই। কেউই বিশেষ কথা বলার মতো অবস্থায় ছিলেন না। মৃত্যুঞ্জয়ের দাদা প্রদীপ বলেন, “ভাই বুধবার বিকেলেই সান্ত্বনার বাড়িতে গিয়েছিল ওদের নিয়ে আসতে। বাড়িতে অষ্টমঙ্গলার প্রস্তুতি চলছিল। আজ ভাইয়ের মোবাইল থেকে আমার ফোনে ফোন আসে। ভেবেছিলাম ওরা ফিরছে সেই খবর দিতেই ফোন করছে।’’
ফোন করেছিলেন এক পুলিশ কর্মী। তিনিই দুর্ঘটনার খবর দেন। আর কিছু বলতে পারেন না প্রদীপ। পাশে তখন হাউহাউ করে কেঁদে চলেছেন রেখাদেবী আর সমরবাবু। তাঁদের পড়শি কার্তিক কুণ্ডু বলেন, “কত ধুমধাম করে বিয়ে বাড়িতে আনন্দ করলাম আমরা। এত বড় একটা অনুষ্ঠানের পরেই এমন ঘটনা ঘটে গেল। কী বলে সান্ত্বনা দেব জানি না।’’
সহ-প্রতিবেদন: প্রশান্ত পাল
এবার শুধু খবর পড়া নয়, খবর দেখাও। সাবস্ক্রাইব করুন আমাদের YouTube Channel - এ।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy