শহরের গলিপথে। ছবি: সুজিত মাহাতো
—‘‘কী মাস্টার, তুমি নাকি আবার ভোটে দাঁড়িয়েছ?’’
পুরুলিয়া শহর থেকে বেরিয়ে চাষমোড়ের একটি চায়ের দোকান। বেঞ্চের উপরে এসে বসেন দীর্ঘাকায় প্রৌঢ়। পরনে সাদা পাজামা-পাঞ্জাবি। ধোপদুরস্ত নয়। ঘামের আঠায় রাস্তার ধুলোমাটি জাঁকিয়ে বসেছে কাপড়ে। এসে বসতেই এমন একটা প্রশ্ন এল। প্রৌঢ় গুছিয়ে বসলেন। বললেন, ‘‘হ্যাঁ।’’ তারপরে জমে উঠল কথা। সেটাই তাঁর ‘ভোট-প্রচার’।
তিনি মৃত্যুঞ্জয় মাহাতো। বয়স সাতান্ন ছুঁয়েছে। সাকিন, পুরুলিয়া মফস্সল থানার গাড়াফুসড় গ্রাম। পেশা প্রাথমিক স্কুলে শিক্ষকতা। এক কালে ফরওয়ার্ড ব্লকের রাজনীতিতে সক্রিয় ছিলেন। তার পরে নাম লেখান জনবাদী ফরওয়ার্ড ব্লকে। ২০০৬ সালের পর থেকে বিধানসভা ভোটে জয়পুর বা বলরামপুর কেন্দ্রের প্রার্থী তালিকায় প্রায়ই তাঁর নাম দেখা যায়। নির্দল হিসেবে। লোকসভা ভোটেও দাঁড়ান। তবে প্রচারটা বলরামপুর, জয়পুর আর শহরের কিছু জায়গার বাইরে আর করে উঠতে পারেন না।
তিনি সুভাষচন্দ্রের নামে মেলার আয়োজন করেন। গণবিবাহের আয়োজন করেন। শর্ত একটাই, পণ নেওয়া চলবে না। সেই মৃত্যুঞ্জয়বাবু মুখে মুখে শুনিয়ে তাঁর ভোটের ‘ইস্তেহার’। সুভাষচন্দ্র বসুর আদর্শে দেশ গড়ে তুলতে হবে। আর সেই দেশে নেশা বলে কোনও বস্তু থাকবে না। সবাইকে বলেন, ‘‘যদি এই কথায় বিশ্বাস করেন, তাহলে ভোট দেবেন। না হলে চাই না।’’ ভোটে দাঁড়াতে হলে প্রার্থী হিসাবে নামটা কাউকে প্রস্তাব করতে হয়। নেশা করেন না, এমন লোকই মৃত্যুঞ্জয়বাবুর প্রস্তাবক হন। জানালেন, এ বার তেমন লোক পেতে বিস্তর হ্যাপা হয়েছে।
এ বারের লোকসভায় পুরুলিয়া কেন্দ্র থেকে তিনি দাঁড়িয়েছিলেন ‘ব্যাটসম্যান’ প্রতীকে। যে প্রশ্নটা নিয়মিত শুনতে হয়েছে, সেটা হল, এ ভাবে কি জেতা যায়? ‘‘যায় না। জানি। কিন্তু আদর্শটা আমি যতদূর পারি ছড়িয়ে দিতে চাই। তার জন্যই ভোট ব্যাপারটা কাজে আসে,’’ বলছিলেন মৃত্যুঞ্জয়বাবু। এ বার ফল বেরোতে দেখা গিয়েছে, তিনি রয়েছেন সবার শেষে। মোট প্রায় সাড়ে তেরো লক্ষ মানুষ এই কেন্দ্রে ভোট দিয়েছিলেন। তিনি পেয়েছেন তাঁদের মধ্যে হাজার দশেক লোকের সমর্থন। বলছেন, ‘‘একটু একটু করেই তো হবে।’’
কী ভাবে হবে, চায়ের দোকানে এসে বসতে সেটাই জানতে চেয়েছিলেন গুলাপ আনসারি আর রাখহরি পরামানিক। ডিমডিহা গ্রামের দুই যুবক রাজমিস্ত্রীর কাজ করেন। বলরামপুর, জয়পুর আর পুরুলিয়া সদরের অনেকের মতো তাঁদেরও আলাপ রয়েছে মৃত্যুঞ্জয়-মাস্টারের সঙ্গে। জিজ্ঞাসা করছিলেন, ‘‘অন্যদের মতো প্রচার তো করতে পারবে না। আর জিতেই যদি যাও, দিল্লি গিয়ে করবেটা কী? তুমি তো একা।’’ উত্তরে শুনেছেন, ‘‘হওয়ার হলে এ ভাবেই হবে। নেশা করা লোকের ভোট নিয়ে দিল্লি যাওয়ার ডাক নেতাজি দেননি।’’
এক সময়ে লোকসভা ভোটে দাঁড়াতে দশ হাজার টাকা জামানত লাগত। পরে বেড়ে পঁচিশ হয়। দুই সময়েই লড়েছেন তিনি। জামানত বাজেয়াপ্ত হয়েছে। দমে যাননি। ভোটাভুটির ব্যাকরণ থেকেও নড়েননি।
এ বারও গণনাকেন্দ্রের বাইরে ক্যাম্প ছিল মৃত্যুঞ্জয়বাবুর। সেই ক্যাম্পে জনা পনেরো লোকও ছিলেন। কেউ স্বজন, কেউ সুহৃদ। সেই কথা শোনা গেল ফরওয়ার্ড ব্লকের জেলা সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য অসীম সিংহের মুখে। তিনি জানাচ্ছেন মৃত্যুঞ্জয়বাবুকে নিয়ে
একবার গন্ডগোল পাকিয়ে উঠেছিল। ফরওয়ার্ড ব্লক পঞ্চায়েত সমিতিতে লড়ার টিকিট দিয়েছিল তাঁকে। তিনি জেলা পরিষদের জন্য জমা করে ফেলেছিলেন। অসীমবাবু বলেন, ‘‘উনি সুভাষচন্দ্রের আদর্শে বিশ্বাস করেন।
কিন্তু সেই আদর্শ যে ভাবে প্রতিষ্ঠা করতে চান, সেটা তাঁর নিজস্ব পথ। আমাদের সঙ্গে মেলে না।’’
জেলার এক সময়ের ফরওয়ার্ড ব্লক সাংসদ ছিলেন নরহরি মাহাতো। সম্প্রতি বিজেপিতে যোগ দিয়ে সেই দলের পুরুলিয়া লোকসভার চেয়ারম্যান হয়েছেন। বলেন, ‘‘মৃত্যুঞ্জয়বাবুর কথা শুনেছি। ওঁর ভোটে দাঁড়ানোর বাতিক আছে বলেই জানি।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy