মৌসুমী চৌধুরী। নিজস্ব চিত্র
দীর্ঘ অনুশীলন শেষে কুমারী নদীর চরের কাশবন থেকে বেরিয়ে ছৌয়ের মুখোশ খুলে ফেলেন মহিষাসুরমর্দিনী পালার দুর্গা। এগিয়ে যান সাইকেলের দিকে। মুখোশের যেখানে তৃতীয় নয়ন আঁকা, ঠিক সেখানে ছোট্ট কালো টিপ। মৌসুমী চৌধুরী। বছর বাইশের এই যুবতীর উৎসাহেই গত সাত-আট বছরে বীর রসের ছৌয়ের পরিসর বদলে গিয়েছে পুরুলিয়ায়।
এখন জেলায় মেয়েদের ছৌ-দল রয়েছে চারটি। দশ বছর আগে, ২০১০ সালে যখন ইউনেস্কোর ‘ইনট্যানজিবল কালচারাল হেরিটেজেস অফ হিউম্যানিটি’-র প্রতিনিধিত্বমূলক তালিকায় নাম উঠেছিল পুরুলিয়ার এই লোকসংস্কৃতির, তখনও এমনটা ভাবতে পারত না কেউ। বিশাল মুকুট-সহ দেবীর মুখোশ পরার অধিকার মেয়েদের মধ্যে নিয়ে আসেন মৌসুমী।
সেটা ছিল ২০১২ সালে শীতকাল। মৌসুমীদের গ্রাম, বলরামপুরের প্রত্যন্ত মালডিতে নতুন প্রজন্মের ছেলেদের ছৌ শেখাতে একটি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার সহায়তায় কর্মশালা হচ্ছে। মৌসুমীর বাবা, ছৌ-শিল্পী জগন্নাথ চৌধুরী সেখানে ব্যস্ত। স্কুলপডুয়া মেয়ে গিয়ে বলেছিল, সে আরও মেয়েদের নিয়ে নাচ শিখে দল করতে চায়। তার আগে ঘরের দরজা এঁটে ছোট বোন শ্যামলীকে নিয়ে বাবার মতো নাচার চেষ্টা চলেছে অনেক দিন। হয়েছে বন্ধুদের মধ্যে স্বপ্ন-ভাগাভাগি।
জগন্নাথবাবু জানান, শুনে তিনি এবং তাঁর স্ত্রী রুবিদেবী দ্বিধায় পড়ে গিয়েছিলেন। লোকেও পরে নানা কথা বলেছে। কিন্তু ছৌ-গুরুরা মত দিয়েছিলেন এক কথায়। জেলার বিশিষ্ট ছৌ-গুরু বীণাধর কুমার বলেন, ‘‘মেয়েটার শেখার চেষ্টা আছে। ওরা ভাল নাচছে।’’ গত কয়েকবছরে দলের শ্যামলী, শিখা, মঞ্জু, কণিকা-সহ দলের বাকিদের নিয়ে মৌসুমী পাড়ি দিয়েছেন দিল্লি, ওড়িশা, ঝাড়খণ্ড। গিয়েছেন নরওয়ে। কয়েকমাস আগে বাংলাদেশ আর সিঙ্গাপুরে যাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু করোনার-পরিস্থিতিতে সফর বাতিল হয়েছে।
পনেরো জন মেয়ের ছৌ-দল নিয়ে অনুষ্ঠান করেন পুরুলিয়া ২ ব্লকের জামবাদের অপর্ণা মাহাতো। তিনি বলেন, ‘‘মেয়েরাও যে ছৌ নাচতে পারে, সেই পথটা দেখিয়েছে মৌসুমী।’’ নিজের আগ্রহ থেকে পুরোহিত পরিবারের ছেলে জগন্নাথবাবু নাড়া বেঁধেছিলেন ছৌ-শিল্পী নেপাল মাহাতোর কাছে। মৌসুমী বলেন, ‘‘ছোটবেলায় ভাবতাম, নাচের আসরে স্বর্গ থেকে দেবতারা নেমে আসে। এক বার আসর থেকে ফিরে পোশাকগুলো আমায় ধুতে দিয়েছিল। তখন থেকেই আমার নাচের স্বপ্ন দেখা শুরু।’’
গ্রামের কৃষক পরিবারের ফুটবলভক্ত কিশোরী সরলা মুড়াকে ছৌয়ে টেনে এনেছিলেন মৌসুমী। এখন বলরামপুর কলেজের ছাত্রী সরলা অনুষ্ঠান করতে দূরে যান। দলে মৌসুমী আছেন জেনে বাড়ির লোক চিন্তা করেন না। সুইসা কলেজে ছৌয়ের ডিপ্লোমায় ভর্তির সময়ে সিধো-কানহো বীরসা বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার নচিকেতা বন্দ্যোপাধ্যায় প্রথম দেখেন মৌসুমীকে। তিনি বলেন, ‘‘নাক-এর প্রতিনিধিরা যখন পরিদর্শনে এসেছিলেন, ও ছিল আমাদের সাংস্কৃতিক মুখ। এখন এই বিশ্ববিদ্যালয়েরই বাংলা বিভাগে স্নাতকোত্তর পড়ছে।’’
মৌসুমী বলেন, ‘‘আমরা নাচ শুরু করার পরে, বাবা-মায়েদের অনেক কথা শুনতে হয়েছে। অনুষ্ঠান করতে বিদেশ ঘুরে আসার পরে, সেই লোকজনই ভাল ভাল কথা বলে গিয়েছে।’’ অতীতের ধুলো ঘাঁটতে চান না মৌসুমী। মনে রাখেন, বছর দু’য়েক আগে ঝাড়খণ্ডের নিমডিতে নাচের পরে মুখোশ খোলার সময়ে কিছু মহিলা অবাক হয়ে দেখতে এসেছিলেন, বীরদর্পে এতক্ষণ যে মাটিতে কাঁপন ধরাল, সে সত্যি একটি মেয়ে! (শেষ)
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy