Advertisement
২২ নভেম্বর ২০২৪
Freedom Fighters

Bankura: ছেঁদাপাথরে এখনও রয়েছে অগ্নিযুগের বিপ্লবীদের গোপন সুড়ঙ্গ, মনে জাগায় বিস্ময়

কলকাতা ও কলকাতার বাইরে গড়ে ওঠা অগ্নিযুগের গুপ্ত সমিতিগুলিকে এক ছাতার তলায় এনে দিয়েছিল বাঁকুড়ার ছেঁদাপাথরের গোপন বিপ্লবী ঘাঁটি।

ছেঁদাপাথরে বিপ্লবীদের সুড়ঙ্গ।

ছেঁদাপাথরে বিপ্লবীদের সুড়ঙ্গ। নিজস্ব চিত্র।

নিজস্ব সংবাদদাতা
বাঁকুড়া শেষ আপডেট: ১৪ অগস্ট ২০২১ ১৭:০২
Share: Save:

বিংশ শতকের গোড়ার দিকে অবিভক্ত বাংলায় ব্রিটিশ বিরোধী সশস্ত্র আন্দোলন মাথাচাড়া দিতে শুরু করেছিল। একে একে বাংলার বিভিন্ন জায়গায় গোপনে গঠিত হয় গুপ্ত সমিতি। সেগুলির সঙ্গে যুক্ত বিপ্লবীদের অস্ত্র প্রশিক্ষণের উদ্যেশ্যে বাঁকুড়ার ঘন জঙ্গলের মধ্যে তৈরি হয়েছিল এক গুপ্ত ঘাঁটি । বারিকুল থানার ছেঁদাপাথরের অদূরের সেই গোপন ঘাঁটি ও আত্মগোপনের জন্য তৈরি সুড়ঙ্গ একশো বছর পরেও বিস্ময়ের জন্ম দেয়।

অগ্নিযুগে মেদিনীপুর ও বাঁকুড়ায় একাধিক সশস্ত্র বিপ্লবী গোষ্ঠী তৈরি হয়েছিল। বাঁকুড়া শহরের কালীতলার অদূরে হরিহর মুখোপাধ্যায়ের বাড়িতে রামদাস চক্রবর্তীর নেতৃত্বে তৈরি হয়েছিল কুস্তির আখড়া। যা রামদাস পালোয়ানের আখড়া হিসেবে পরিচিত ছিল। এই আখড়ায় গোপনে যাতায়াত ছিল স্বাধীনতা সংগ্রামীদের। সে কালে সূর্যাস্ত আইনে রাজত্ব হারিয়ে বাঁকুড়ার অম্বিকানগরের রাজা রাইচরণ ধবলদেও পৃথক ভাবে ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে সশস্ত্র আন্দোলন গড়ে তুলেছিলেন। তাঁর নেতৃত্বে বাঁকুড়ার জঙ্গলমহলে প্রায় তিনশো ভূমিজ ও সর্দার শ্রেণির প্রতিনিধিকে নিয়ে হয়েছিল সশস্ত্র গোষ্ঠী। পার্শ্ববর্তী মেদিনীপুর জেলাতেও সত্যেন্দ্রনাথ বসুর নেতৃত্বে গুপ্ত সমিতিগুলি গোপনে কাজ চালিয়ে যাচ্ছিল।

গবেষকদের একাংশের ধারণা, কলকাতা ও কলকাতার বাইরে গড়ে ওঠা অগ্নিযুগের এই সব সশস্ত্র গুপ্ত সমিতিগুলির বিপ্লবীদের এক ছাতার তলায় এনে দিয়েছিল বাঁকুড়ার ছেঁদাপাথরের গোপন বিপ্লবী ঘাঁটি। সে সময় বিপ্লবীদের অস্ত্র প্রশিক্ষণ বা অস্ত্র তৈরি করা যত্রতত্র সম্ভব ছিল না । এ জন্য ব্রিটিশ পুলিশের চোখের আড়ালে থাকা একটি জায়গার প্রয়োজন ছিল। সেই প্রয়োজন মেটায় ছেঁদাপাথর। রাজা রাইচরণ এবং বাঁকুড়ার হিড়বাঁধে সদ্য কেনা জমিদারির মালিক নরেন গোঁসাই বিপ্লবীদের জায়গাটির সন্ধান দিয়েছিলেন। এখান থেকে পশ্চিমে গেলে পুরুলিয়া জেলা, দক্ষিণে মেদিনীপুর জেলা আর দক্ষিণ-পশ্চিমে কিছুটা এগোলেই অধূনা ঝাড়খন্ড তৎকালীন বিহার প্রদেশ। কলকাতার অনুশীলন সমিতি-সহ রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্তের গুপ্ত সমিতির বিপ্লবীরা স্থান সরেজমিনে খতিয়ে দেখে সিদ্ধান্ত নেন ছেঁদাপাথর গ্রামের অদূরেই তৈরি হবে গোপন অস্ত্র প্রশিক্ষণ শিবির। নরেন গোঁসাই ও রাজা রাইচরণের প্রত্যক্ষ পৃষ্ঠপোষকতায় শাল, পিয়াল, মহুয়ার ঘন জঙ্গলে ঢাকা পাহাড়ি এই এলাকাতেই লোকালয় থেকে বেশ কিছুটা দূরে গড়ে উঠেছিল ঘাঁটি। আত্মগোপনের বিকল্প ব্যবস্থা হিসাবে মাটির তলায় তৈরি করা হয় সুড়ঙ্গ। গবেষকদের কেউ কেউ বলেন, বোমা বা বন্দুকের অনুশীলনের সময় শব্দ যাতে ছড়িয়ে না পড়ে সেই জন্যই এই সুড়ঙ্গ তৈরি করেছিলেন বিপ্লবীরা।

গবেষকদের ধারণা, ১৯০৪ থেকে ১৯০৮ সালের মধ্যে বিপ্লবীদের এই গোপন ঘাঁটিতে একাধিকবার এসেছেন বারীন্দ্রনাথ ঘোষ, সত্যেন্দ্রনাথ বসু , ভূপেন্দ্রনাথ দত্ত, প্রফুল্ল চাকি-সহ অগ্নিযুগের বিপ্লবীরা। ক্ষুদিরাম বসু এই গোপন ঘাঁটিতে এসেছিলেন কি না, তা নিয়ে গবেষকদের মধ্যে মতভেদ থাকলেও স্থানীয় বাসিন্দাদের দাবি, ক্ষুদিরাম এই গোপন ঘাঁটিতে এসে আত্মগোপন করেছিলেন। বিপ্লবী কর্মকান্ড চালানোর জন্য প্রয়োজনীয় অর্থ সংগ্রহের উদ্দেশ্যে একাধিক ডাকাতির পরিকল্পনাও এই গোপন ঘাঁটিতেই তৈরি হয়েছিল বলে জানা যায়। ১৯০৮ সালে আলিপুর ষড়যন্ত্র মামলায় নরেন গোঁসাই রাজসাক্ষী হয়ে আদালতে দাঁড়িয়ে ছেঁদাপাথরের গোপন বিপ্লবী ঘাঁটির কথা জানিয়ে দেন। বাধ্য হয়ে বিপ্লবীরা ঘাঁটি ছেড়ে চলে যান।

বাঁকুড়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যপক তথা লোক গবেষক অরবিন্দ চট্টোপাধ্যায় বলেন, “রাজা রাইচর এবং নরেন গোঁসাইয়ের নেতৃত্বে ছেঁদাপাথরে গড়ে ওঠা বিপ্লবীদের এই আস্তানা আসলে বাংলার সমস্ত বিপ্লবী গুপ্ত সমিতির মিলনস্থল হয়ে উঠেছিল। এই গোপন ঘাঁটি থেকেই মানবাজারে গালার কারখানায় ও ঘাটশিলা রাজবাড়িতে বৈপ্লবিক ডাকাতি করে প্রচুর অর্থ সংগ্রহ করেন বিপ্লবীরা । যা পরবর্তীতে সশস্ত্র সংগ্রামকে এগিয়ে নিয়ে যেতে সাহায্য করেছিল।’’

ছেঁদাপাথর শহীদ ক্ষুদিরাম এস টি হাইস্কুলের ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক মানস মুখোপাধ্যায় বলেন, ‘‘সেসময় এই ছেঁদাপাথর এলাকা দুর্গম জঙ্গলে ঢাকা ছিল। লোকজনের বসবাসও তেমন ছিল না। ফলে লোকচক্ষুর আড়ালে বিপ্লবীরা এসে তাঁদের অস্ত্র প্রশিক্ষণ ও অস্ত্র তৈরির কাজ করতে পারতেন।’’ ছেঁদাপাথর গ্রামের বাসিন্দা মঙ্গল হাঁসদা বলেন, “আমার দাদু ও তাঁর সমবয়সীদের মুখে শুনতাম ওই সুড়ঙ্গর মধ্যে বিপ্লবীরা বোমা ও গুলি ছোঁড়া শিখতেন। পাশেই একটি কাঁচা দেওয়াল ও খড়ের চালার বাড়ি ছিল। সেই বাড়িতে থাকতেন বিপ্লবীরা। প্রায়ই ঘোড়ায় চড়ে দুর্গম জঙ্গলের রাস্তা ধরে গোপন ঘাঁটিতে আসতেন রাজা রাইচরণ।’’

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy