(বাঁ দিক থেকে) জানকী শিকারি ও জবা শিকারি। নিজস্ব চিত্র
নারীশিক্ষায় বীরহোড় সম্প্রদায়কে আরও এক কদম এগিয়ে দিলেন পুরুলিয়ার অযোধ্যা পাহাড়তলির ভূপতিপল্লির মেয়ে জানকী শিকারি। বীরহোড় মেয়েদের মধ্যে তিনি প্রথম উচ্চ মাধ্যমিকের গণ্ডি পার করেছেন বলে দাবি শিক্ষকদের। এ বার মাধ্যমিকে উত্তীর্ণ হয়েছে আর এক বীরহোড় কন্যা জবা শিকারি। তাঁদের নিয়ে উচ্ছ্বসিত গ্রামের বাসিন্দারা। পুরুলিয়ার জেলাশাসক রাহুল মজুমদার বলেন, ‘‘ওই দুই ছাত্রীকে প্রশাসনের তরফে সংবর্ধনা দেওয়া হবে। তাঁদের দেখে অন্যেরাও অনুপ্রাণিত হবেন।’’
বাঘমুণ্ডির পণ্ডিত রঘুনাথ মুর্মু আবাসিক বিদ্যালয়ের ছাত্রী জানকীর এই সাফল্যে খুশি স্কুলের শিক্ষক সৌরভ দত্তের দাবি, ‘‘বীরহোড়দের মেয়েদের মধ্যে জানকীই প্রথম উচ্চ মাধ্যমিকে উত্তীর্ণ হলেন। এমন একটা পরিবেশ থেকে তাঁর এই সাফল্য কম বড় ব্যাপার নয়।’’ তাঁর স্কুলেরই ছাত্রী জবা।
এক সময়ে জঙ্গলই ছিল বীরহোড়দের সংসার। শিকার করেই তাঁরা জীবনধারণ করতেন। জঙ্গল থেকে লোকালয়ে আসতেও তাঁরা চাইতেন না।
বীরহোড়দের নিয়ে গবেষণা করা বলরামপুর কলেজের ইতিহাসের শিক্ষক শিবশঙ্কর সিংহ বলেন, ‘‘কয়েক দশক আগে জঙ্গল থেকে বীরহোড়দের খুঁজে এনে প্রশাসন বাঘমুণ্ডির ভূপতিপল্লিতে মাথার উপরে ছাদ করে দেয়। কিন্তু এখনও তাঁদের জঙ্গলের প্রতি টান রয়ে গিয়েছে। অনেকে এখনও জঙ্গলের উপরে নির্ভরশীল। কেউ-কেউ দিনমজুরি করছেন, ভাড়ার গাড়িও চালাচ্ছেন। তবে পড়াশোনার গুরুত্ব নিয়ে কেউ-কেউ বিশেষ ভাবিত নন।’’
তবে ভোলানাথ শিকারি মেয়েদের পড়ানোয় ফাঁকি দিতে নারাজ। তাঁর দুই মেয়ে জানকি ও রথনি বছর দুই আগে এক সঙ্গে মাধ্যমিক পাশ করে প্রমাণ করেছিলেন, বীরহোড়দের মেয়েরাও পড়াশোনা চালিয়ে যেতে চান। তবে তাঁদের দেখে এখন বীরহোড় পরিবারের কেউ কেউ মেয়েদের স্কুলে পাঠাচ্ছেন।
পেশায় দিনমজুর ভোলনাথবাবু বলেন, ‘‘জানকী উচ্চ মাধ্যমিকে ২১৭ নম্বর পেলেও রথনির অসম্পূর্ণ ফল এসেছে। তাই খুশির মধ্যেও কিছুটা মন খারাপ লাগছে।’’ তিনি জানান, শৈশবেই তাঁর বাবা হীরালাল শিকারিকে হারান। মা মাকড়িদেবী তাঁকে বড় করেন। মায়ের ইচ্ছাতেই তিনি ষষ্ঠ শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশোনা করেছেন। ভোলানাথবাবু বলেন, ‘‘মা-বাবা দু’জনেই নিরক্ষর ছিলেন। মায়ের ইচ্ছে ছিল, আমি লেখাপড়া শিখি। কিন্তু বেশি দূর পড়তে না পারার আক্ষেপ ছিল। তাই দুই মেয়েকে কোনও ভাবে স্কুল বন্ধ করতে দিইনি।’’ পাশ থেকে তাঁর স্ত্রী তুরিদেবী বলেন, ‘‘আমরা সব সময়ে মেয়েদের পড়াশোনায় উৎসাহ দিই।’’
জানকীর কথায়, ‘‘আমরা যেন লেখাপড়া না ছাড়ি, সে কথা বাবা-মা আমাদের বারবার বলেন। এ বার আমি কলেজে ভর্তি হব। শিক্ষকতা করতে চাই।’’ তিনি সাফল্যের জন্য স্কুলের শিক্ষকদের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন।
শৈশবেই বাবাকে হারিয়েছে জবা। সে এ বার মাধ্যমিকে ২১২ নম্বর পেয়েছে। তার কথায়, ‘‘মা মঙ্গলি শিকারিই আমাদের ভরসা। অভাবের জন্য দুই দিদি লেখাপড়া করতে পারেনি। সেই দুঃখ মায়ের আজও রয়েছে। তাই আমাকে লেখাপড়া শেখানোর জন্য মা এক রকম জেদ করেছিলেন। মা বারবার বলেন, ‘তোকে লেখাপড়া শিখতেই হবে। তোর জন্য আমি দিনরাত খাটব।’ মাকে খুশি করতে পেরে ভাল লাগছে।’’
এই দুই পরিবারের পাশে দাঁড়িয়েছেন বাঘমুণ্ডির কংগ্রেস বিধায়ক নেপাল মাহাতো। তিনি বলেন, ‘‘লুপ্তপ্রায় এই সম্প্রদায়ের ছাত্রীরা নারীশিক্ষায় নেতৃত্ব দিয়েছে। অন্য ছাত্রীদের কাছে তারা অনুপ্রেরণা। তারা যত দিন পড়াশোনা করবে, লেখাপড়ার সমস্ত খরচ আমরা বহন করব।’’
বীরহোড়দের নিয়ে কাজ করা সপ্তর্ষি বৈশ্যের কথায়, ‘‘জানকী-রথনির পরে জবা। ধীরে ধীরে বীরহোড়দের মেয়েদের মধ্যে অশিক্ষার আঁধার কাটছে।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy