বিস্ফোরণের তীব্রতায় পরিত্যক্ত আবাসনের দেওয়াল ধসে গিয়েছে। খুলে বেরিয়ে এসেছে জানলা। ছবি: কল্যাণ আচার্য
দু’বছরের ব্যবধান। আবার বিস্ফোরণে কেঁপে উঠল দাঁড়কা পঞ্চায়েত এলাকা। বুধবার গভীর রাতে দাঁড়কা প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রের পরিত্যক্ত আবাসনে বোমা বিস্ফোরণে আতঙ্ক ছড়ালেও এটা নতুন কোনও ঘটনা নয় দাঁড়কার বাসিন্দাদের কাছে। ওই পঞ্চায়েত এলাকায় বিস্ফোরণ এবং গোলাগুলির ব্যবহার প্রায় সংস্কৃতির পর্যায়ে পৌঁছে গিয়েছে বলে বাসিন্দাদের দাবি।
এলাকার বাসিন্দাদের দাবি, মূলত রাজনৈতিক ক্ষমতা তথা গ্রাম দখল এবং বালির ঘাটের দখল নিয়েই বারবার তেতে উঠেছে দাঁড়কা পঞ্চায়েত এলাকা। গোলাগুলির ব্যবহারের পাশাপাশি হতাহতের ঘটনাও ঘটেছে। ২০১৭ সালে দাঁড়কা লাগোয়া দরবারপুরে বালিঘাটের বিরোধের জেরে বোমা বিস্ফোরণে ৯ জনের মৃত্যু হয়। ওই ঘটনায় প্রচুর হইচই হলেও পরিস্থিতি বিশেষ বদলায়নি। মাস তিনেক আগেই দাঁড়কা স্বাস্থ্যকেন্দ্রের পুলিশ ক্যাম্প লক্ষ্য করে গভীর রাতে তিনটি বোমা ছোড়া হয়। তার মধ্যে দু’টি ফাটে। একটি পুলিশ সকালে উদ্ধার করে। অনেকের মতে, এলাকার দখল নিতে পুলিশ ক্যাম্প সরাতেই দুষ্কৃতীরা বোমা ছুড়েছিল। পুলিশ যদিও সে সময় বোমা মারার কথা স্বীকার করেনি।
স্থানীয় সূত্রে জানা গিয়েছে, ওই স্বাস্থ্যকেন্দ্রে ডাক্তার এবং অন্য স্বাস্থ্যকর্মীদের থাকার জন্য আলাদা আলাদা আবাসন রয়েছে। কিন্তু দীর্ঘদিন ধরে ওই সব আবাসনে কেউ থাকেন না। পরিত্যক্ত আবাসন বর্তমানে স্থানীয় বাসিন্দাদের জ্বালানি, খড়-সহ বিভিন্ন গৃহস্থালী সামগ্রী সংরক্ষণের জায়গা হয়ে দাঁড়িয়েছে। একমাত্র আউটডোর ভবনটিই ব্যবহারযোগ্য রয়েছে। সেখানে সকাল ১০ থেকে ১২ পর্যন্ত রোগী দেখা হয়। বিস্ফোরণের পরে রাতেই এলাকায় আতঙ্ক ছড়ায়। সকলে বেরিয়ে পড়েন বাড়ি ছেড়ে। স্বাস্থ্যকেন্দ্রের কাছেই বাড়ি মেহেরজান শেখের। তিনি বলছিলেন, ‘‘আমি আর স্ত্রী ঘুমিয়েছিলাম। আচমকা বিস্ফোরণের শব্দে ঘুম ভেঙে যায়। সঙ্গে সঙ্গে অ্যাসবেস্টসের চাল-সহ ফ্যান ভেঙে পড়ে যায়। উঠে দেখি, স্বাস্থ্যকেন্দ্রের দরজা-জানলার ফ্রেমের দুটো কাঠ ছিটকে এসে ঘরের চালে পড়েছে। তাতেই ওই বিপত্তি। আর একটা পড়ে রয়েছে বাড়ির বারন্দায়। অল্পের জন্য বেঁচে গিয়েছি।’’ শেখ আবর কাশেম, হারাই শেখরদের কথায়, ‘‘ওই সব পরিত্যক্ত কোয়ার্টারে দিনের বেলায় আমাদের ছেলেমেয়েরা খেলাধুলো করে। তখন বিস্ফোরণ হলে কী হত, তা ভেবেই হাড় হিম হয়ে যাচ্ছে।’’
পুলিশের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তুলে তৃণমূলের বিক্ষোভ। নিজস্ব চিত্র
এই বিস্ফোরণের পরে পরেই এলাকার নিরাপত্তার প্রশ্নটি সামনে এসে পড়েছে। এলাকার শান্তি রক্ষার্থে স্বাস্থ্যকেন্দ্রের একটি আবাসনে দীর্ঘদিন ধরে রয়েছে অস্থায়ী পুলিশ ক্যাম্প। স্থানীয় মানুষজন জানতে চাইছেন, পুলিশ থাকা সত্ত্বেও যদি এত পরিমাণ বোমা মজুত করা হয়, তা হলে ক্যাম্প থাকার মানে কী ? এলাকায় দুষ্কৃতী দমনে পুলিশের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে খোদ শাসকদলই। এ দিনই স্বাস্থ্যকেন্দ্রের গেটের সামনে রাস্তায় আগুন জ্বালিয়ে লাভপুরের ওসি চয়ন ঘোষের অপসারণের দাবিতে বিক্ষোভ দেখাতে থাকেন তৃণমূলের কর্মী সমর্থকেরা। তৃণমূলের দাঁড়কা অঞ্চল সভাপতি কাজল রায়ের অভিযোগ, ‘‘ওসি-র গাফিলতিতেই এমন ঘটনা ঘটেছে। বিভিন্ন অভিযোগে অভিযুক্ত বিজেপি আশ্রিত দুষ্কৃতীরা এলাকায় বুক ফুলিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। পুলিশকে জানানো সত্ত্বেও তাদের ধরা হয়নি। তারাই ওই সব দুষ্কর্ম করছে।’’
পুলিশ অবশ্য গাফিলতির অভিযোগ মানেনি। জেলার পুলিশ সুপার শ্যাম সিংহ বলেন, ‘‘আমার অত্যন্ত গুরুত্ব দিয়ে ঘটনার তদন্ত করছি। সিনিয়র পুলিশ আধিকারিকেরা ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছেন। আমরা সব পক্ষের ভূমিকাই খতিয়ে দেখছি।’’
ঘটনা যাই ঘটে থাকুক, বিস্ফোরণের জেরে ফের সেই এলাকা দখলের রাজনীতি সামনে এসে পড়েছে। গত পঞ্চায়েত নির্বাচনে বিরোধীরা দাঁড়কা পঞ্চায়েতে কোনও প্রার্থী দিতে পারেনি। ১৯টি আসনই বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় দখল করে তৃণমূল। কিন্তু, সাম্প্রতিক লোকসভা নির্বাচনে পঞ্চায়েত ভিত্তিক ফলাফলের নিরিখে ৯টি আসনে এগিয়ে রয়েছে বিজেপি। তার মধ্যে দাঁড়কা গ্রামের তিনটি আসনই তাদের দখলে। তার উপরে লাভপুরের তৃণমূল বিধায়ক মনিরুল ইসলাম ভোটের পরে পরেই বিজেপি-তে যোগ দিয়েছেন। তাঁর বাড়িও এই দাঁড়কা পঞ্চায়েতের নবগ্রামে।
সেই কারণেই দু’পক্ষের সংঘাত বাড়ছে বলে মনে করছে রাজনৈতিক মহল। বালির ঘাট দখল কেন্দ্রিক সংঘাতের তত্ত্বও উড়িয়ে দিচ্ছেন না স্থানীয় বাসিন্দারা। মনিরুলের রাজনৈতিক গুরু তথা তৃণমূলের জেলা সহ-সভাপতি আব্দুল মান্নানের অভিযোগ, ‘‘বিভিন্ন খুনে অভিযুক্ত মনিরুলের অনুগামীরাই ওই সব পরিত্যক্ত আবাসনে আশ্রয় নিয়েছিল। ওরাই বালিঘাট আর এলাকা দখলের জন্য ওইসব বোমা মজুত করেছিল।’’ অভিযোগ অস্বীকার করে মনিরুল ইসলাম দাবি করেছেন, যে ঘরে বিস্ফোরণ ঘটেছে, সেই ঘরে আব্দুল মান্নানের
অনুগামী এক কাঠ ব্যবসায়ীর কাঠ ছিল। আরও যে-সব নাম শোনা যাচ্ছে, তারাও মান্নানের অনুগামী বালি মাফিয়া। স্বাস্থ্যকেন্দ্রের ওইসব পরিত্যক্ত আবাসন তাদের আস্তানা ছিল বলে শুনেছি। বোমা মজুত করলে ওরাই করে থাকবে।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy