কীর্তনের ভক্ত ভুবন বাদ্যকর। —নিজস্ব চিত্র।
গান যে আমার জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দেবে, স্বপ্নেও কোনও দিন ভাবিনি। ছোটবেলার কথা আজকাল খুব মনে পড়ে। আর্থিক কারণে পড়াশোনার সুযোগ হয়নি। কিন্তু ছোট থেকেই বিভিন্ন জায়গায় গান শুনে তা গাওয়ার চেষ্টা করতাম। কীর্তন খুব পছন্দের ছিল। গাইতামও। আজও গাই। তবে দুবরাজপুরের কুড়ালজুড়ি গ্রামের এই ভুবন যে একটা গানের কারণেই বিখ্যাত হয়ে যাবে, তা ভাবিনি কখনও! কাঁচা বাদাম বিক্রি করতাম। থাকতামও কাঁচা বাড়িতে। ওই গানের কল্যাণেই আমার এখন পাকা বাড়ি। খুব আনন্দ হয় আজকাল।
কিন্তু এমনটা কিছু দিন আগেও ছিল না। আমি তো খুবই গরিব পরিবারের ছেলে। অনটনের সংসার ছিল। ছোট থেকে গ্রামে দিনমজুরের কাজ করতাম। বছর বারো আগে হঠাৎ এক দিন বাদাম বিক্রি করা শুরু করি। একটা ভাঙা সাইকেল আর কাঁচা বাদামের ডালা। এ গ্রাম ও গ্রাম ঘুরে বাদাম বিক্রি করে বেড়াতাম। গান সব সময়েই আমার খুব প্ৰিয়। তাই বাদাম বিক্রি করতে করতেও গান গাইতাম। তাতে লোকজনের আমাকে আলাদা করে চিনতে সুবিধা হত।
এক দিন বাদাম বিক্রি করতে করতেই একটা গান বেঁধে ফেললাম। সেই গানই আমার জীবন পাল্টে দিল। প্রথমে কেউ আমার ওই ‘বাদাম বাদাম’ গানটা ভিডিয়ো করে মেটমাধ্যমে দিয়ে দেয়। আমি টেরও পাইনি। বুঝতেও পারিনি যে, আমার গাওয়া ওই গান ভাইরাল হয়ে গিয়েছে। আচমকা বুঝতে পারলাম, অনেকে আমার খোঁজ করছেন। অনেকেই আমার বাড়িতে আসতে শুরু করলেন। পরে বুঝতে পারি, আমার গান ভাইরাল হয়েছে। এর পর অনেকে আমাকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন।
একটা মোটরবাইক কিনলাম। সাইকেল ছেড়ে মোটরবাইকেই বাদাম নিয়ে ঘোরাঘুরি। মোটরবাইকটা খুব দরকার ছিল। সাইকেল নিয়ে আসলে বেশি দূরে যাওয়া সম্ভব হত না। মোটরবাইক কেনার পর থেকে আমি অনেক দূর দূর যেতাম বাদাম বিক্রি করতে। কিছু দিন আগে একটা গাড়ি কিনি। তবে সে গাড়ি দিয়ে দিয়েছি। বাইকটা এখনও আমার সঙ্গী।
এই শুভাকাঙ্ক্ষীদের কারণেই আজ আমার পাকা বাড়ি হয়েছে। আজ আমি আর্থিক ভাবে সচ্ছল। আগে মাটির বাড়িতে থাকতাম। খড়ের চাল। ছোট্ট বাড়ি। আমরা ওই বাড়ির একটা ঘরেই সকলে মিলে থাকতাম। সপরিবার। মেয়ের বিয়ে হয়ে গিয়েছে। দুই ছেলের মধ্যে একটির বিয়ে হয়েছে। সেই ছেলে আমার মতোই বাদাম বিক্রি করে। তবে সে ভাজাবাদাম বিক্রি করে। মাটির বাড়ির মতো এই পাকা বাড়িতেও আমরা সকলে একসঙ্গে থাকি।
এই বাড়ি করতেও অনেক কষ্ট হয়েছে। আমার গান ভাইরাল হওয়ার পর যা টাকা পেয়েছি সব জমিয়ে এই বাড়ি করেছি। পুরনো বাড়ির পাশেই একটু জায়গা ছিল। সেখানে বাড়ি করার জন্য সরকারি প্রকল্পে ১ লাখ ২০ হাজার টাকা পেয়েছিলাম। ওই টাকায় বাড়ির ভিতটা সামান্য তুলতে পেরেছিলাম। আর কিছু করতে পারিনি। তার পরেই তো লকডাউন শুরু হয়ে গেল। ফলে টাকা ভেঙে ফেলতে হয়েছিল। বাড়ির কাজও আটকে যায়। এখন আমার হাতে সামান্য টাকা আসায় বাড়ি তৈরি করেছি। অনেক কাজ এখনও বাকি।
বাড়ির অন্দরসজ্জা অনেকেই দেখেছেন জানি। আনন্দবাজার অনলাইন তো খবরও করেছে। তবে অন্দরসজ্জার জন্য আমার নিজের টাকা খরচ হয়নি। আমি একটি সংস্থায় গান করেছিলাম। বিনিময়ে টাকা নিইনি। বলেছিলাম, আমার বাড়িটা সাজিয়ে দিতে হবে। সেইমতো তারা বাড়ির অন্দরসজ্জার কাজ করে দেয়।
এই বাড়িতে দুটো ঘর, একটি শৌচাগার এবং সিঁড়ির নীচে রান্নাঘর। আমি কৃষ্ণের ভজনা করি। কৃষ্ণ নাম বাড়িতে লেখা। বাড়ি এখনও পুরো রং হয়নি। তবে থাকার মতো করে নিয়েছি। বারান্দা আর দু’টি ঘরে মার্বল বসানো হয়েছে। ঘরও এক দিন নিশ্চয়ই সাজাতে পারব।
জানি না আমার ভবিষ্যৎ কী! আমি একদম সাধারণ মুখ্যুসুখ্যু মানুষ। তবে আমার এই গানের জন্যে মানুষের যা ভালবাসা পেয়েছি, তা চিরজীবন মনে থাকবে। বাদাম বিক্রি করাই আমাকে উপরের দিকে নিয়ে এসেছে। তাই ওটা আমাকে করতেই হবে। এখন সময় পাচ্ছি না। এই মাস থেকেই বাদাম বিক্রি আবার শুরু করার ইচ্ছে রয়েছে।
একটা কথা লিখেই শেষ করব। আমার আজ যা কিছু, সব এই নেটমাধ্যমের জন্য। আমি সকলের কাছে চির কৃতজ্ঞ।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy