গ্রামবাসীর সঙ্গে কথা বলছেন ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট ও বিডিও। নিজস্ব চিত্র
বিষ্ণুপুরে তৃণমূলের বেলশুলিয়া পঞ্চায়েতে কী চলছে, তা জানতে বাঁকুড়ার জেলাশাসকের নির্দেশে শুক্রবার সেখানে তদন্তে গেলেন দুই আধিকারিক। তদন্ত কমিটি গঠন করছে বাঁকুড়া জেলা তৃণমূলও।
বাঁকুড়ার জেলাশাসক এস অরুণ প্রসাদ এ দিন বলেন, “বেলশুলিয়া পঞ্চায়েতের দুর্নীতির অভিযোগের তদন্ত কত দূর হয়েছে, তা নিয়ে বিষ্ণুপুর মহকুমা প্রশাসনের কাছে খোঁজ নিচ্ছি।” বিকেলে এসডিও (বিষ্ণুপুর) অনুপকুমার দত্ত বলেন, ‘‘জেলাশাসকের নির্দেশে ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট দেবর্ষি মুখোপাধ্যায় ও বিডিও (বিষ্ণুপুর) স্নেহাশিস দত্তকে নিয়ে তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। তাঁরা এ দিন দুপুরে বেলশুলিয়া পঞ্চায়েতে যান। সেখানকার নথিপত্র পরীক্ষা করে তাঁদের গ্রামবাসীর সঙ্গে কথা বলেন।’’ এসডিও জানান, তিনিও এর মধ্যে বেলশুলিয়ায় যাবেন। যত শীঘ্র সম্ভব তদন্ত করে রিপোর্ট জেলাশাসকের কাছে পাঠানো হবে।
জেলা তৃণমূল সভাপতি শুভাশিস বটব্যাল বলেন, ‘‘তিন জনের একটি তদন্ত কমিটি গড়ে বেলশুলিয়া পঞ্চায়েতের জনপ্রতিনিধিদের বিরুদ্ধে ওঠা দুর্নীতির সত্যাসত্য যাচাই করা হবে। আগামী মঙ্গলবার দলের জেলা পর্যবেক্ষক তথা পরিবহণ মন্ত্রী শুভেন্দু অধিকারীর বাঁকুড়ায় আসার কথা রয়েছে। তার আগেই তদন্ত করে শুভেন্দুবাবুকে সে রিপোর্ট দেওয়ার চেষ্টা করা হবে। তার পরে তিনি যেমন নির্দেশ দেবেন, তেমন কাজ হবে।”
বিষ্ণুপুর ব্লকের বেলশুলিয়া পঞ্চায়েতের ১৩টি আসনের সব ক’টিতেই গত পঞ্চায়েত নির্বাচনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় দখল করেছিল তৃণমূল। তবে বিনা খরচের নানা সরকারি প্রকল্পের সুযোগ পেতে বেলশুলিয়া পঞ্চায়েতের প্রধান এবং সদস্যদের একাংশকে কার্যত ‘প্রণামী’ না দিলে কিছুই মিলছে না বলে অভিযোগ এলাকাবাসীর। পঞ্চায়েতের প্রধান ও তাঁর বিক্ষুদ্ধ পঞ্চায়েত সদস্যেরাও ইদানীং পরস্পরের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগে সরব হয়েছেন।
বিডিও (বিষ্ণুপুর) স্নেহাশিস দত্ত বলেন, ‘‘বেলশুলিয়া পঞ্চায়েতের প্রধান ও সদস্যেরা পরস্পরের বিরুদ্ধে যে সব অভিযোগ এনেছেন, সব ক’টির তদন্ত হচ্ছে। কড়া নজর রয়েছে পঞ্চায়েতের কাজে। আগামী সোমবার পঞ্চায়েতের সদস্যেরা ছাড়াও, ওই এলাকার পঞ্চায়েত সমিতির সদস্য এবং জেলা পরিষদের সদস্যকে ব্লক অফিসে বৈঠকে ডাকা হয়েছে।’’
বেলশুলিয়ার বাসিন্দাদের একাংশ সম্প্রতি বিডিওর কাছে প্রধানের বিরুদ্ধে ত্রাণের ত্রিপল নেওয়া, একশো দিনের জব কার্ড বানানো-সহ বিভিন্ন সরকারি প্রকল্পের সুবিধা দিতে ‘কাটমানি’ নেওয়ার লিখিত অভিযোগ জমা করেন। প্রধানের বিরুদ্ধে বিডিও-কে আলাদা ভাবে অভিযোগ জানিয়েছেন দলেরই আট পঞ্চায়েত সদস্য (দু’জন পরে অভিযোগ প্রত্যাহার করেন) এবং দলের বুথ কমিটি। আবার স্বয়ং প্রধান ওই বিক্ষুদ্ধ সদস্যদের বিরুদ্ধেই পাল্টা দুর্নীতির অভিযোগ জানিয়েছেন দলের অঞ্চল সভাপতিকে (ঘটনাচক্রে, তাঁর বিরুদ্ধেও টাকা চাওয়ার
অভিযোগ রয়েছে)।
ছাড় পাচ্ছেন না পঞ্চায়েতের কর্মীরাও। ৭ জুলাই তাঁরা বিডিও-র কাছে অভিযোগপত্র দিয়ে জানিয়েছেন, তৃণমূলের অঞ্চল সভাপতি তাঁর মর্জিমাফিক কাজ না করায় একশো দিনের কাজে বাধা দিয়েছেন। আবার তাঁর ভাই তথা পঞ্চায়েত সদস্য এক পঞ্চায়েত কর্মীর হাত-পা ভেঙে দেওয়ার হুমকি দিয়েছেন বলেও অভিযোগপত্রে জানানো হয়েছে। ওই ঘটনায় পঞ্চায়েত প্রধান কৃষ্ণা সর্দার দলের জেলা সভাপতির কাছে মৌখিক ভাবে অঞ্চল সভাপতির নামে নালিশও করে আসেন।
অভিযোগ উঠলেও তা মানেননি পঞ্চায়েতের প্রধান কৃষ্ণা সর্দার কিংবা তাঁর বিক্ষুদ্ধ বলে এলাকায় পরিচিত পঞ্চায়েত সদস্য আবু তাহের মণ্ডল, বকুল সর্দার, সুনীল পাত্রেরা। তাঁরা পরস্পরের বিরুদ্ধে চক্রান্ত করে মিথ্যা অভিযোগ তোলার কথা দাবি করে এসেছেন। দলের অঞ্চল সভাপতিও দলের একাংশের নামে তাঁর বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের অভিযোগ তুলেছেন।
পঞ্চায়েতের কর্মীদের ‘হেনস্থার’ ঘটনার নিন্দা করে এ দিন পঞ্চায়েত প্রধান-সহ আট সদস্য বিডিও-কে চিঠি দিয়ে জানিয়েছেন, ‘যাঁরা পঞ্চায়েতের কর্মীদের উপরে অনৈতিক চাপ সৃষ্টি করবেন, তাঁদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে’। প্রধান সমস্ত সদস্যদের নিয়ে কাজ করবেন বলেও চিঠিতে জানিয়েছেন। কিন্তু অভিযুক্ত পঞ্চায়েত সদস্য-সহ বাকিরা চিঠিতে সই করেননি কেন?
পঞ্চায়েত প্রধান বলেন, ‘‘সমস্ত সদস্যকে এ দিন পঞ্চায়েত অফিসে ডাকা হয়েছিল। কয়েকজন এসেছিলেন। কারা, কেন আসেননি জানি না।’’ দলের অঞ্চল সভাপতিকে ফোন করা হলে ‘‘মিথ্যা অভিযোগে ফাঁসানোর চেষ্টা চলছে’’ বলে তিনি লাইন কেটে দেন।
গোটা ঘটনায় তৃণমূলের অন্দরে প্রশ্ন উঠেছে বিষ্ণুপুর ব্লক নেতৃত্বের ভূমিকা নিয়ে। জেলা তৃণমূলের এক নেতা বলেন, “এত কিছু ঘটছে বেলশুলিয়ায়, অথচ ব্লক নেতৃত্বের তরফে জেলাকে কিছুই জানানো হয়নি।” এ নিয়ে তৃণমূলের বিষ্ণুপুর ব্লক সভাপতি তথা রাজ্যের প্রাক্তন মন্ত্রী শ্যাম মুখোপাধ্যায় বলেন, “বেলশুলিয়ার দলীয় কর্মীরা আমাকে অভিযোগ জানানোর পাশাপাশি, রাজ্য নেতৃত্বকেও জানিয়েছেন। বিষয়টি নিয়ে যখন তাঁরাও ওয়াকিবহাল, তখন রাজ্য থেকে নির্দেশ না এলে কী
করতে পারি?”
শুভাশিসবাবুর আক্ষেপ, “শ্যামবাবু দীর্ঘদিন ধরে বেলশুলিয়ায় চলতে থাকা এই সমস্যা জেনেও জেলা নেতৃত্বকে না জানানোয় আমি অবাক। জানলে আগেই পদক্ষেপ করতাম। সদ্য সেখানকার অঞ্চল নেতৃত্বের কাছ থেকে কানাঘুষোয় বিষয়টি শুনেছিলাম। জল যে এত দূর গড়িয়েছে, আমার জানা ছিল না।”
ঘটনা জেনে বিষ্ণুপুরের বিজেপি সাংসদ সৌমিত্র খাঁয়ের টিপ্পনী, “তৃণমূল দলটাই আগাগোড়া দুর্নীতিতে ভরে গিয়েছে। ওঁদের দলের তরফে যাঁরা তদন্ত করবেন, তাঁরা না আবার কাটমানি খেয়ে অন্য রকম
রিপোর্ট দেন!’’
জেলা তৃণমূল সভাপতি অবশ্য দাবি করেন, “নিরপেক্ষ তদন্তের স্বার্থে বিষ্ণুপুর ব্লকের কাউকে তদন্ত কমিটিতে রাখছি না। বাঁকুড়ার এক জেলা-নেতাকে তদন্ত কমিটির মাথায় রেখে দু’টি ভিন্ন ব্লকের দলীয় নেতাকে তদন্ত কমিটিতে নেওয়া হবে।”
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy