তারাপীঠ মন্দিরে হেমন্ত সোরেন। ডিসেম্বর, ২০২০। ফাইল চিত্র।
জেলার একেবারে লাগোয়া রাজ্য ঝাড়খণ্ড। নানা কারণে বীরভূম থেকে ঝাড়খণ্ডে, ঝাড়খণ্ড থেকে বীরভূমে যাতায়াত চলেই। সেই পড়শি রাজ্য ঝাড়খণ্ডের আদিবাসী মুখ্যমন্ত্রী হেমন্ত সোরেনকে এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টরেট (ইডি) গ্রেফতার করার পরে ক্ষুব্ধ বীরভূমের আদিবাসী সম্প্রদায়ের একটা বড় অংশ।
শাসক দল তৃণমূলের দাবি, যে ভাবে আদিবাসী মুখ্যমন্ত্রীকে গ্রেফতার করিয়ে কেন্দ্রের বিজেপি সরকার ঝাড়খণ্ডে নির্বাচিত সরকার ফেলার চেষ্টা হয়েছিল, লোকসভা ভোটে জেলার আদিবাসীরা তার জবাব দেবেন। বিজেপির পাল্টা দাবি, দুর্নীতির অভিযোগের তদন্তেই যা হওয়ার তা হয়েছে।
তবে লাগোয়া ঝাড়খণ্ডের রাজনীতির সাম্প্রতিক টানাপড়েনের প্রভাব অবশ্য ভালই টের পাওয়া যাচ্ছে বীরভূমের আদিবাসী সমাজে। ব্যক্তিগত মত বিনিময়ে, আলাপচারিতায়, বা সমাজমাধ্যমে— এর প্রকাশ ঘটছে সর্বত্র। জেলার আদিবাসীদের মূল ক্ষোভ, যে ভাবে একজন জনজাতি সম্প্রদায়ের মুখ্যমন্ত্রীকে ‘অপদস্থ’ করা হল সেটা নিয়েই। কেন্দ্রে ক্ষমতাসীন বিজেপির বিরোধী জোটের হাতে থাকা ঝাড়খণ্ড সরকার ফেলে দেওয়ার চক্রান্ত হিসেবেই দেখছেন এই ঘটনাকে দেখছেন অনেকে। তাঁদের দাবি, ‘‘ইডি নয়। নেপথ্যে বিজেপি। তবে আস্থা ভোটে চম্পই সরেন সংখ্যাগরিষ্ঠতা প্রমাণ করায় বিজেপির সেই চক্রান্ত ব্যর্থ হয়েছে।’’
দিশম আদিবাসী গাঁওতার (বীরভূম গাঁওতার নতুন নাম) সম্পাদক রবীন সরেন বলছেন, ‘‘বিজেপির প্রতি আমার কোনও অ্যালার্জি নেই। কেউ অন্যায় করে থাকলে আইন মেনে শাস্তি পাবেন। কিন্তু সময় আর নাটকটা দেখতে হবে। বিহারের সরকার ফেলে যে হেতু বিজেপিকে সঙ্গী করে সরকার হল, সেখানে ইস্তফা দিয়ে পর মুহূর্তে শপথ নিলেন মুখ্যমন্ত্রী। কিন্তু ঝাড়খণ্ডে যেহেতু সেটা হল না, সেখানে আস্থা ভোট। এটাই মনে দাগ কাটছে।’’
প্রায় একই সুর আদিবাসীদের অপর সংগঠন জাকাত মাঝি পরগানা মহলের জেলা সভাপতি ঘাসিরাম হেমব্রমের। তিনি বলছেন, ‘‘যে রাজ্যে বিজেপি ক্ষমতায় নেই, সেই রাজ্যের নেতামন্ত্রীদের বিরুদ্ধে যে কেন্দ্রীয় সংস্থা লাগানো হচ্ছে, সেটা স্পষ্ট। আমার ব্যক্তিগত মত, ঝাড়খণ্ডের মুখ্যমন্ত্রী হেমন্ত সোরেনও রাজনৈতিক চক্রান্তের শিকার। সামাজিক সংগঠন করি। তবে বলতে পারি, যে ভাবে হেমন্ত সোরেনকে সরানো হল, তা আদিবাসী সমাজের সার্বিক সম্মানে লেগেছে।’’
বীরভূম জেলায় ১০০ কিমির বেশি সীমানা জুড়ে রয়েছে বীরভূমের সঙ্গে। জেলায় আদিবাসী মানুষজনের সংখ্যাও কম নয়। তথ্য বলছে, তা জেলার মোট জনসংখ্যার প্রায় ৭.৫ শতাংশ। এ বার জেলায় আদিবাসী ভোটারের সংখ্যা ২৯ লক্ষ ছাড়িয়েছে। শতাংশের হিসাবে আদিবাসীদের সংখ্যা ও ভোট খুব গুরুত্বপূর্ণ। তাই লোকসভা নির্বাচনের আগে পড়শি রাজ্যে যা ঘটেছে তার প্রভাব পড়বে নির্বাচনে মনে করছেন অনেকেই। মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে শপথ নিয়ে ২০২০ সালে বাবা-মা কে নিয়ে বীরভূমের তারাপীঠে পুজোও দিয়ে গিয়েছিলেন হেমন্ত। তাই তাঁর এ হেন গ্রেফতারির প্রভাব যে কিছুটা বীরভূমে পড়বেই, তা মানছে সব পক্ষই।
যাঁরা ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন, তাঁদের একজন সিউড়ি আরটি গার্লস স্কুলের প্রধান শিক্ষিকা ক্রিস্টিনা মার্ডি। তিনি বলছেন, ‘‘কেউ দোষী হলে অবশ্যই শাস্তি পাবেন। কিন্তু সেটা যদি কোনও বিশেষ গোষ্ঠী বা জাতিকে লক্ষ্য করে করা হয়, সেটা সমর্থন করি না। আদিবাসীদের উন্নতি কে চায়?’’ তাঁর সংযোজন, ‘‘আমার পড়াশোনা ঝাড়খণ্ডে। বেশ কয়েকজন আদিবাসী মুখ্যমন্ত্রীকে দেখার সুযোগ হয়েছে। তাঁদের মধ্যে সেরা হেমন্ত। ওঁকে এ ভাবে অপদস্থ করা ভাল হয়নি।’’
প্রায় একই সুর মহম্মদবাজারের হরিণশিঙা প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক লুলিন সরেনেরও। তিনি বললেন, ‘‘আমার ব্যক্তিগত মত, এটা কেন্দ্র সরকারের চাল। সোমবার বিধানসভায় দাঁড়িয়ে যে ভাবে হেমন্ত তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগকে চ্যালেঞ্জ করেছেন, তাতে মনে হচ্ছে মিথ্যা মামলা দিয়ে আদিবাসীদের দমিয়ে রাখার চেষ্টা হচ্ছে।’’
হেমন্তের গ্রেফতারির পরেই তাঁকে ‘প্রিয় বন্ধু’ আখ্যা দিয়ে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর পাশে দাঁড়িয়েছিলেন। এক্স হ্যান্ডলে মমতা লিখেছিলেন, ‘‘শক্তিশালী আদিবাসী নেতা হেমন্ত সোরেনের গ্রেফতারির তীব্র নিন্দা জানাই। বিজেপির কথায় কেন্দ্রীয় এজেন্সি একটি নির্বচিত সরকারকে দুর্বল করার ষড়যন্ত্র করছে। এটা প্রতিহিংসামূলক ষড়যন্ত্র।’’
লোকসভা ভোটে যে আদিবাসী জনগোষ্ঠীর এই ক্ষোভকে শাসক দল কাজে লাগাতে চাইবে তা মানছেন দলের নেতাকর্মীরা। শাসক দলের আদিবাসী নেতা সুনীল সরেন বলছেন, ‘‘হেমন্তের বিরুদ্ধে অভিযোগ অনেক আগের। কেন ভোটের আগে গ্রেফতার করা হল সেটা সবাই বোঝেন। আদিবাসী সমাজ এর জবাব দেবেন।’’
লোকসভার প্রচারে বিষয়টি তৃণমূলের তরফে তুলে ধরা হবে কি না সেই প্রশ্নে অবশ্য প্রকাশ্যে মন্তব্য করতে চাননি শাসক দলের নেতারা। দলের সহ-সভাপতি মলয় মুখোপাধ্যায় বলেন, ‘‘এ ব্যাপারে মুখ্যমন্ত্রী যা বলার বলেছেন। আদিবাসীরা বিষয়টি বোঝেন। আমাদের প্রতি কোনও নির্দেশ এলে সেটা যথাযথভাবে পালন করার চেষ্টা করব।’’
তবে বিজেপি নেতৃত্বের দাবি, এর কোনও প্রভাব বীরভূমে পড়বে না। দলের বীরভূম সাংগঠনিক দলের সভাপতি ধ্রুব সাহা বলেন, ‘‘হেমন্ত সরেন অন্যায় করলে যে তাঁকে গ্রেফতার করা উচিত তা চেয়েছিলেন সেখানকার আদিবাসী সমাজের একাংশই। ঝাড়খণ্ডের ঘটনার প্রভাব এ রাজ্যে বা লাগোয়া বীরভূমে পড়বে না।’’ বিজেপির বোলপুর সাংগঠনিক জেলার সভাপতি সন্ন্যাসীচরণ মণ্ডল বলছেন, ‘‘বিজেপি নয়, হেমন্ত সরেনকে গ্রেফতার করেছে কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থা। সরকার আর দলকে গুলিয়ে ফেললে চলবে না। আদিবাসীদের সমস্যায় ফেলতে চাইছে কেন্দ্র সরকার, এই প্রশ্ন উঠছে কেন? দেশের রাষ্ট্রপতিই তো আদিবাসী।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy