সনৎ বন্দ্যোপাধ্যায়ের সেই সংগ্রহশালা। নিজস্ব চিত্র।
খ্যাপার মতো ‘পরশ পাথর’ খুঁজে ফেরেন দুর্গাপুরের স্টিল টাউনশিপের আইনস্টাইন এলাকার বাসিন্দা সনৎ বন্দ্যোপাধ্যায়। তাঁর এমন অভ্যাস দেখে কেউ কেউ তাঁকে ‘খ্যাপা’ই বলেন। তিনি খুঁজে বেড়ান আকরিক। যে আকর থেকে ভেসে আসে ইতিহাসের গন্ধ। আমাদের আশপাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা সব কিছুর মধ্যে ইতিহাসকে খুঁজে ফেরেন সনৎ। আর সেই ইতিহাস ছুঁয়ে বর্তমানে থাকা সমস্ত কিছুই সনতের আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু। এ হেন সনৎ বাঁকুড়ার পাঁচাল গ্রামে টিনের ছাউনি দেওয়া মাটির বাড়িতে খুলে ফেলেছেন ইতিহাসের সেই সব আকরিকের একটি সংগ্রহশালাও। যা এখন শুধু এ রাজ্য বা দেশ নয় , বিদেশের মানুষের কাছেও গন্তব্য।সনতের ঘাড়ে পুরনো জিনিস সংগ্রহের নেশাটা চেপে বসেছিল বছর ছ’য়েক আগে । পুরুলিয়ার মণিহারায় নিজের বাড়িতে বসে একটি তোরঙ্গ ঘাঁটতে গিয়ে তাঁর চোখে পড়ে বেশ কিছু দলিল দস্তাবেজ । সেই দলিল দস্তাবেজে তিনি দেখতে পান আট আনা এবং ষোল আনা মূল্যের স্ট্যাম্প পেপারে রাজারানির ছাপ। দলিলটি উর্দু ভাষায় হাতে লেখা। দেড়শো থেকে দু’শো বছরের পুরানো সেই সব দলিল দস্তাবেজ দেখে সনতের মাথায় চেপে বসে পুরনো জিনিস সংগ্রহের নেশা। এর পর পাগলের মতো চলতে থাকে তাঁর খোঁজ। এক সময় দুর্গাপুরের মলানদিঘি গ্রামে তারাচরণ ন্যায়রত্নের উত্তরসূরিদের সঙ্গে আলাপ হয় সনতের। তাঁদের বাড়িতে রাখা কিছু পুঁথি দেখে সংগ্রহের ইচ্ছেটা আরও চেপে বসে। তিনি জানতে পারেন, স্বয়ং বিদ্যাসাগর বিধবাবিবাহের সম্মতি চেয়ে পণ্ডিত তারাচরণ ন্যায়রত্নকে তিন খানা চিঠি লিখেছিলেন। পুঁথিপত্রের স্তূপ তন্নতন্ন করে খুঁজে একটি চিঠি উদ্ধার করেন সনৎ। তবে সে চিঠি বিদ্যাসাগরের লেখা কি না তা নিয়ে নিশ্চিত নন গবেষকরা। এর পর থেকে ধীরে ধীরে সনতের সংগ্রহ বাড়তে থাকে। জমতে থাকে পুরনো চিঠি, ডাকঘরের টিকিট, পুরনো মুদ্রা, পুরনো ক্যামেরা, চরকা, আলো, রেডিও। দুর্গাপুর স্টিল প্ল্যান্টের কর্মী সনতের কথায়, “প্রথম প্রথম যা কিছু সংগ্রহ করতাম সবই আমি আমার কোয়ার্টারে রাখতাম। কিন্তু ধীরে ধীরে সংগ্রহ এতটাই বেড়ে গেল যে কোয়ার্টারে আর রাখা সম্ভব হচ্ছিল না। তা ছাড়া ভেবেছিলাম, আমার সংগ্রহ করা সামগ্রী যদি আমার ঘরেই বন্দি থাকে তবে তার মূল্য ক’জন জানবে। এই সময় বাঁকুড়ার সোনামুখী ব্লকের পাঁচাল গ্রামের কয়েক জন যুবক তাঁদের হাতে গড়া বিজ্ঞান ও সমাজ নামের একটি সংগঠনের খড়ের ছাউনি দেওয়া মাটির বাড়িকে সংগ্রহশালা করার জন্য অনুমতি দেন। সেই বাড়িতেই আমার সংগ্রহ করা সামগ্রী দিয়ে ২০১৯ সালে পথ চলা শুরু করে চেতনা লোক সংগ্রহশালা।’’
কী নেই সনতের সংগ্রহশালায়! দেড়শো বছরের পুরনো অ্যালুমিনিয়াম কাস্টিং ক্যামেরা থেকে আধুনিক ক্যামেরা, সাধারণ টাইপ রাইটার থেকে ফ্রান্সে তৈরি মাত্র তিন ইঞ্চি উচ্চতার টাইপ রাইটার, পেট্রোম্যাক্স, বিভিন্ন ধরনের ডে লাইট থেকে শুরু করে ডেভিস ল্যাম্প, হ্যারিকেন, লন্ঠন, কুপি, নানা মাপের রেডিও, রেডিওগ্রাম যন্ত্র, নানা আকারের টেলিফোন, ঘড়ি আছে এই সংগ্রহশালায়। আছে মানুষের দৈনন্দিন ব্যবহারের জিনিসপত্রও। লাঙল, মই, গরুর গাড়ির চাকা, মাছ ধরার বিভিন্ন সামগ্রী, বিভিন্ন পট, নকশি কাঁথাও রয়েছে। সনতের দাবি, তাঁর সংগ্রহশালায় প্রায় ৮ হাজার ডাক টিকিট, ৩ হাজার প্রাচীন মুদ্রা এবং অসংখ্য প্রাচীন পুঁথিও রয়েছে। তাঁর আক্ষেপ, “ছোট সংগ্রহশালায় পরিকাঠামো এবং জায়গার অভাব থাকায় এক হাজারেরও বেশি বই দুর্গাপুরে নিজের কোয়ার্টারে রাখতে বাধ্য হয়েছি। দর্শনার্থী ও পাঠকরা সেই বই এর অমূল্য আকর চাক্ষুষ করা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। ’’
প্রত্যন্ত গ্রামে সনতের নিজের হাতে গড়ে তোলা এমন সংগ্রহশালা দেখতে শুধু স্থানীয়রাই নন দেশ বিদেশের বহু আগ্রহী মানুষও পা বাড়ান পাঁচাল গ্রামের লাল পথে। সনৎ বলছেন, “ইতিহাস ফিরে ফিরে আসে। সেই একই নিয়মে প্রযুক্তি এবং সংস্কৃতি বারবার ফিরে আসে আমাদের জীবন এবং জীবিকায়। পুরনো শিল্প এবং সংস্কৃতিকে ভূলে যাওয়া ঠিক নয়। সমাজের সুস্থায়ী উন্নয়নের জন্য হারিয়ে যাওয়া বা হারিয়ে যেতে বসা প্রযুক্তি ও সংস্কৃতি অনেক বেশি কার্যকর ভূমিকা নেয় বলে আমার ধারণা । সেই ধারণাকে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে বয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্যেই আমি এই লড়াই চালিয়ে যাচ্ছি।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy