পড়াচ্ছেন নারায়ণ। —নিজস্ব চিত্র।
বছর বারো আগে প্রাথমিকের গণ্ডিতেই স্কুলছুট হয়ে যেত গ্রামের বড় সংখ্যক ছাত্র-ছাত্রীর। একক চেষ্টায় হতাশার সেই ছবিটা অনেকটাই বদলে দিয়েছেন ইতিহাসে স্নাতকোত্তর পাশ বেকার যুবক নারায়ণ হাঁসদা। গ্রামের খুদে পড়ুয়াদের জন্য নিজের বাড়িতে স্বেচ্ছা পাঠদানকেন্দ্র খুলেছেন তিনি।
লাভপুরের কালিকাপুরডাঙা গ্রামের এক হতদরিদ্র পরিবারের সন্তান বছর আটত্রিশের নারায়ণ। বাবা পরমেশ্বর ছিলেন যৎসামান্য বেতনের চালকল কর্মী৷ চার ভাইবোনের তৃতীয় নারায়ণ। অর্থাভাবে অন্য ছেলে-মেয়েদের পড়াতে না পারলেও পরমেশ্বর চেয়েছিলেন নারায়ণ উচ্চশিক্ষা লাভ করুক। কিন্তু কলেজে পড়াকালীন পরমেশ্বরের মৃত্যু হয়। তাঁর ইচ্ছাপূরণ করতে প্রতিকূলতার সঙ্গে লড়াই করে ইতিহাসে স্নাতকোত্তর পাশ করেছেন ছেলে নারায়ণ। কিন্তু কোনও চাকরি জোটেনি। তবুও পড়াশোনার প্রতি অনুরাগ অটুট রয়েছে।
নিজের গ্রামের ছেলে-মেয়েদের পড়াশোনা বজায় রাখার দায় স্বেচ্ছায় নিজের ঘাড়ে তুলে নিয়েছেন নারায়ণ। আদিবাসী অধ্যুষিত ওই গ্রামে প্রায় ১৩০টি হতদরিদ্র পরিবারের বাস। অধিকাংশই প্রথম প্রজন্মের পড়ুয়া। বাড়িতে পড়াশোনা দেখিয়ে দেওয়ার কেউ নেই। গৃহশিক্ষক রাখার ক্ষমতাও নেই। তাই প্রাথমিকে গণ্ডি পেরনোর আগেই অধিকাংশই স্কুলছুট হয়ে যেত। সেই প্রবণতা রুখতেই বছর বারো আগে ১০ জন পড়ুয়াকে নিয়ে নারায়ণ শুরু করেন স্বেচ্ছা পাঠদানকেন্দ্র। এখন পড়ুয়ার সংখ্যা ৪২।
এ খানেই থেমে নেই তাঁর উদ্যোগ। দূরবর্তী গ্রামের আট-দশ জন ছেলে-মেয়েকে ধারাবাহিক ভাবে নিজের বাড়িতে রেখে স্বেচ্ছা পাঠদানের পাশাপাশি খাওয়ার ব্যয়ভারও বহন করে চলেছেন নারায়ণ। তাঁর স্বেচ্ছা পাঠদানকেন্দ্রে পড়াশোনা করে এ পর্যন্ত ১৫ জন আদিবাসী ছাত্র-ছাত্রী মাধ্যমিক এবং পাঁচ জন উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করেছে। নারায়ণের ওই স্বেচ্ছা পাঠদানকেন্দ্রে পড়াশোনা করে কলেজে পড়ছেন সুস্মিতা হাজরা, মৌমিতা সোরেনেরা। তাঁরা বলেন, ‘‘স্বেচ্ছা পাঠদানকেন্দ্র না থাকলে আমরা এতদূর এগিয়ে আসতে পারতাম না।’’
নারায়ণের বাড়িতে থেকে পড়াশোনা করছে মল্লারপুরের আগোয়ার বৈশাখী মাড্ডি, রুবিনা সোরেনেরা। তারা বলছে, ‘‘আমাদের বাড়িতে পড়া বুঝিয়ে দেওয়ার মতো কেউ নেই। পড়ার পরিবেশও নেই। নারায়ণ স্যারের বাড়িতে আমরা নিজের পরিবারের মত থাকি। তাঁর কাছে আশ্রয় না পেলে আমাদের পড়া হত না।’’
স্ত্রী বকুল এবং ছ’বছরের মেয়ে নন্দিনীকে নিয়ে নারায়ণের অভাবের সংসার। বিঘে দুয়েক জমি সম্বল। স্ত্রী নন্দিনী উচ্চ মাধ্যমিক পাশ। তিনি দিনমজুরির পাশাপাশি আবাসিক পড়ুয়াদের রান্না করেন। স্বেচ্ছা পাঠদানকেন্দ্র চালাতে গিয়ে নিজের জমিটুকু চাষ করা হয়ে ওঠে না নারায়ণের। গ্রামবাসীরাই পালাক্রমে স্বেচ্ছায় বিনা পারিশ্রমিকে তাঁর জমি চাষের দায় নিজেদের ঘাড়ে তুলে নিয়েছেন। গ্রামের বাসিন্দা বোধন হাঁসদা, ধরম হাঁসদা বলেন, ‘‘আমাদের ছেলে-মেয়েদের পড়াতে গিয়ে ওর জমি অনাবাদী হয়ে পড়ে থাকাটা মেনে নিতে পারছিলাম না। তাই চাষের দায়িত্বটা আমরা স্বেচ্ছায় নিজেদের ঘাড়ে তুলে নিই।’’
নারায়ণ বলছেন, ‘‘ কষ্ট করে লেখাপড়া শিখেছি। নিজের অভিজ্ঞতা থেকে জানি, আমাদের মতো পরিবারের ছেলে-মেয়েরা কেন স্কুলছুট হয়ে যায়। তাই নিজের মতো করে স্কুলছুট রোখার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। সব দিক সামাল দিতে সমস্যা হয়। তবে মাঝেমধ্যে স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা বা শুভানুধ্যায়ীদের পাশে পেয়ে যাই।’’
কালিকাপুরডাঙা প্রাথমিক বিদ্যালয়ের জাতীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক পার্থপ্রদীপ সিংহ বলেন, ‘‘শিক্ষা বিস্তারে ওই যুবক এক ব্যতিক্রমী ভূমিকা পালন করে চলেছেন। তার জন্য এ অঞ্চলে স্কুলছুটের প্রবণতা নেই বললেই চলে৷’’ এলাকার বিধায়ক অভিজিৎ সিংহ বলেন, ‘‘ধন্যবাদ জানিয়ে ওই যুবককে ছোট করতে চাই না। তাঁর পাশে আছি।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy